মিজানুর রহমান তোতা : এবার ক্ষুদে চামড়া ব্যবসায়ীরা দারুণ দুশ্চিন্তায়। অনেকের মাথায় হাত ঊঠেছে। কোরবানির পশুর চামড়া মাঠ থেকে সংগ্রহ খুবই কম। বড় বড় ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকদের দৌঁড়ঝাঁপ নেই। চামড়া কোথায় রাখবে, কবে বিক্রি হবে, এবার এভাবে ধস নামবে কল্পনাও করেনি-এমন নানা হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষুদে চামড়া ব্যবসায়ীরা।
যশোরের রাজারহাট দেশের বৃহত্তম চামড়ার মোকাম। সপ্তাহে দুইদিন শনিবার ও মঙ্গলবার হাট বসে। যশোর ছাড়াও আশপাশের জেলাগুলো থেকে ব্যবসায়ীরা চামড়া নিয়ে হাজির হন এই হাটে। রাজারহাটের এই চামড়াহাটকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় প্রায় ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান। দুই শতাধিক আড়ত রয়েছে এই মোকামে। প্রতি কোরবানির ঈদে রাজারহাটে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার চামড়া বেচাকেনা হয়ে থাকে। ঈদের দিন মঙ্গলবার তা হয়নি বললেই চলে।
যদিও শনিবার হাটে বেচাকেনার আশা করছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। জেলা প্রশাসন চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে পাচাররোধে ব্যবস্থা নিয়েছে। যশোরের পুলিশ সুপার মোঃ আনিসুর রহমান জানান, রাজারহাটে চামড়া পাচার ঠেকাতে ও ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া সীমান্তবর্তী থানাগুলোকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দেয়া আছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সুত্র জানায়, চামড়া পাচার প্রতিরোধে সীমান্তের সব বিওপি ক্যাম্পগুলোতে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। চামড়া পাচার ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে আছে। কোন অবস্থাতে চামড়া পাচার করতে দেয়া হবে না।
যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া ও সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ চামড়ার বেচাকেনার ক্ষেত্রে কোন ব্যবস্থাপনা নেই। চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পের স্বার্থে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া জরুরি। বরাবরই যেটি অনুপস্থিত রয়েছে। সংশিষ্ট একাধিক সুত্র জানায়, বাংলাদেশের গরু ও ছাগলের চামড়া খুবই উন্নতমানের। বিশেষ করে বাছাই করা গরু ও ছাগল কোরবানী দেয়ায় ওই চামড়া খুবই ভালো। বরাবরই চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প পণ্যের ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে চামড়া শিল্প। কোরবানীর পশুর চামড়া থেকেই মুলত দেশের মোট চামড়ার চাহিদা পুরণ হয়ে থাকে। অথচ চামড়ার বাজার ব্যবস্থাপনাও সেইভাবে গড়ে ওঠেনি আজো। নানা কারণে দিনে দিনে পিছিয়ে পড়ছে সম্ভাবনাময় শিল্পটি-এই মন্তব্য করেছেন সচেতন, পর্যবেক্ষক মহল ও চামড়া শিল্পের সাথে জড়িতরা। তারা শিল্পটির দৈন্যদশা কাটাতে সরকারকে আরো জোরদার ভুমিকা রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ট্যানারী শিল্পের অর্থনৈতিক সংকট ও ক্রেতার সংখ্যা কমে যাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে দেশের সীমান্তবর্তী কাঁচা চামড়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ করার ফন্দি-ফিকির আঁটে ভারতের চামড়া ব্যবসায়ীরা। সীমান্ত সুত্র জানায়, সীমান্তের ফাঁকফোকর দিয়ে কোরবানীর পশুর চামড়া ভারতে পাচারের আশংকা রয়েছে প্রবল। ওপার সীমান্ত থেকে গরু করিডোর দিয়ে বাংলাদেশে গরু পাঠানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক কড়াকড়ি করলেও চামড়া সংগ্রহের ব্যাপারে চোরাচালানীদের নানাভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে সীমান্তের একাধিক সুত্র জানিয়েছে।
দেশের বৃহত্তম চামড়ার হাট যশোরের রাজারহাটে নির্ধারিত হাটের দিন ছাড়াও ব্যবসায়ীদের আনাগোনা থাকে মৌসুমের অন্যান্য দিনে। এবার ছিল ব্যািতক্রম। চামড়ার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চামড়ার দাম একেবারেই কম। ক্রেতা নেই বললেই চলে। যা আছে তারা চামড়া ক্রয় করছে না। চামড়া বিক্রি করতে না পেরে হা-হুতাশ করেছেন ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা। গরুর চামড়া ৪০টাকা ও ছাগলের চামড়া ১৫ টাকা নির্ধারণ হলেও বিক্রি ঈদেও দিন চামড়া সংগ্রহের সময় বিকিকিনি হয় একেবারেই পানির দামে। এমনিতেই ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের হাতে নগদ টাকা নেই। ট্যানারী মালিকদের কাছে পাওনা কোটি কোটি টাকা আদায় এখনো অনিশ্চিত। এবার ঈদের দিন বাড়ী বাড়ী চামড়া সংগ্রহকারীদের দেখা মিলেছে একেবারেই কম। সারা বছর তাকিয়ে থাকে এতিম ও মাদ্রাসাগুলো চামড়ার জন্য। যা সংগ্রহ হয় তা দিয়ে তাদেও বছরের বড় অংশের একটা খরচ যোগানো হয়। এবার তা হবে না। কারণ বাড়ি বাড়ি ঘুওে চামড়া সংগ্রহ কওে পারিশ্রমিকের দামও উঠছে না। ক্ষুদে ব্যবসায়িরা তাদের চামড়ার রেট দিচ্ছে গরু ২০টাকা ছাগল বলা যায় ফ্রি।
বৃহত্তর যশোরের চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারী আলাউদ্দীন মুকুল গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, এমনিতেই ব্যাংকের ঋণের সুবিধা সাধারণত কোন সময়ই সাধারণ ব্যবসায়ীরা পান না। অথচ তারাই চামড়া বেচাকেনার প্রথম ধাপে কাজ করেন। তাদের চেয়ে থাকতে হয় ট্যানারী মালিক, পাইকারী ব্যবসায়ী ও বেপারীদের দিকে। কোরবানীর চামড়া ক্রয় করে লাভের আশায় স্থানীয়ভাবে সম্পত্তি বন্ধক রেখে কিংবা ব্যাংক থেকে বাড়তি সুদে ও দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকেন ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এবার তাদের মাথায় হাত উঠেছে। চামড়া বেচাকেনা খুবই কম। গতবার নির্ধারিত রেটের বেশী দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে। এবার একবারেই কমে বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে বিপদে লবন সংকট। রাজারহাটে ঈদের দিন কোথাও লবন পাওয়া যায়নি। পার্শ্ববর্তী বসুন্দিয়া বাজার থেকে প্রতিবস্তা ১৬শ’টাকা দামে কিনে নিয়ে চামড়া রক্ষা করা হয়েছে। অতিরিক্ত দামে লবন কিনে চামড়া রক্ষা করা কর্ঠিন হচ্ছে। কারণ লবনের চেয়ে চামড়ার দাম তুলনামূলক কম সার্বিক হিসেবে। তিনি জানালেন, লবন হচ্ছে চামড়ার প্রাণ। কয়েকঘন্টা লবন দিতে দেরী হলে চামড়ার গুণগত মান নষ্ট হয়। এমনকি পচে যায়। যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া ও সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ সম্ভাবনাম্যয় শিল্প ঘিরে কোন বাজার ব্যবস্থাপনা নেই। চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পের স্বার্থে সরকারকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া অত্যন্ত জরুরি বলে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন