দীর্ঘ ২৭ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি টানার ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্বের সেরা ধনকুবেরদের অন্যতম মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ও তার স্ত্রী মেলিন্ডা। সোমবার টুইটারে তারা এ-সংক্রান্ত ঘোষণা দেন। মেলিন্ডা ১৯৮৭ সালে প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে মাইক্রোসফটে যোগ দেন। একই বছর নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠানের এক নৈশভোজে মেলিন্ডা ও বিল গেটসের সাক্ষাৎ হয়। তারপর তারা দীর্ঘদিন প্রেম করেন। বিল গেটস ও মেলিন্ডা জুটি ১৯৯৪ সালে বিয়ে করেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট’ জার্নালের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিল গেটস বলেছিলেন, বিয়ে করা তার জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত। আর মাইক্রোসফট তার জীবনে বড় অবদান রাখলেও সেটির অবস্থান ২ নম্বরে।
বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ ধনকুবের বিল গেটস ও তার স্ত্রী মেলিন্ডা গেটসের বিচ্ছেদের ঘোষণা আসার পর আলোচনায় উঠে আসছেন তাদের সন্তানেরা। ধনকুবের এই দম্পতির তিন ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়ের নাম জেনিফার গেটস। ছেলে রোরি জন গেটস মেজ। আর ছোট মেয়ে ফিবি অ্যাডেল গেটস। মা-বাবার বিচ্ছেদের পর সন্তানেরা কী পরিমাণ সম্পদের মালিক হচ্ছেন, তা নিয়েও শুরু হয়েছে আলোচনা। তবে মা-বাবা অঢেল সম্পদের মালিক হলেও সন্তানেরা পাচ্ছেন তার খুব সামান্যই। বিল গেটসের উইল অনুযায়ী, তিন সন্তানের প্রত্যেকই পাবেন এক কোটি মার্কিন ডলার, স্ত্রীও পাবেন একই পরিমাণ অর্থ। বাকি অর্থ চলে যাবে ট্রাস্টে। কিন্তু বিচ্ছেদের কারণে এখন যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী মেলিন্ডা পাবেন বিল গেটসের সম্পত্তির অর্ধেক। অর্থাৎ, এক কোটি মার্কিন ডলারের বদলে এখন তিনি পাবেন অন্তত ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।
প্রায় এগার লাখ দুই হাজার চারশত কোটি টাকার মামলা। ডলারে যার পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি ডলার। এই সম্পদ নিয়ে মাইক্রোফট প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বিশ্বের শীর্ষ ধনীর ৪ নম্বর অবস্থানে। সোমবার আকস্মিকভাবে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছেন বিল গেটস ও তার স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস। এ মর্মে আদালতে আবেদন জমা দিয়েছেন। এখন এই অর্থ তাদের মধ্যে যদি অর্ধেক-অর্ধেক বা ৫০-৫০ হিসেবে ভাগ হয় তাহলে শীর্ষ ধনীর চার নম্বর অবস্থান থেকে নেমে ১১ নম্বরে চলে যাবেন বিল গেটস। ফোর্বস ম্যাগাজিনের হিসেবে বিল গেটসের নিট সম্পদ আছে ১২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের। বিচ্ছেদের ফলে এই সম্পদ মেলিন্ডার সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে।
সবচেয়ে বড় অংকের সম্পদের বন্টন হতে যাচ্ছে বিল এবং মেলিন্ডা গেটসের বিচ্ছেদে। তাদের রয়েছে বেশ কিছু রিয়েল এস্টেট। আছে ওয়াশিংটনে নিজস্ব মূল বাড়ি। সম্পদ আছে ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা, উইওমিং এবং ম্যাচাচুসেটসে। উপরন্তু আছে একটি ব্যক্তিগত জেট বিমান। আছে বিস্ময়কর সব আর্টের সংগ্রহ। দ্রæতগামী একগুচ্ছ গাড়ির মালিকও বিল গেটস। মাইক্রোসফটের শতকরা ১.৩৭ ভাগ শেয়ারের মালিক বিল গেটস নিজে। সিএনবিসির মতে, এই অর্থের পরিমাণ কমপক্ষে ২৬০০ কোটি ডলার।
বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস যুক্তরাষ্ট্রে বেসরকারিভাবে সবচেয়ে বেশি কৃষিজমির মালিক। ২ লাখ ৪২ হাজার একর কৃষিজমির মালিক তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ১৮টি অঙ্গরাজ্যে বিল গেটস ও মেলিন্ডা গেটসের মালিকানায় রয়েছে এসব কৃষিজমি। এর মধ্যে লুইজিয়ানায় ৬৯ হাজার ৭১ একর, আরকানসাসে ৪৭ হাজার ৯২৭ একর ও নেব্রাস্কায় ২০ হাজার ৫৮৮ একর কৃষিজমি রয়েছে। তাঁদের বিচ্ছেদ হওয়ায় এখন এই সম্পত্তির ভাগের বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করবে বলেই মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া গেটস পরিবারের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। তাই বিল গেটসের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের আপস-রফা হিসেবে মেলিন্ডা কী পাবেন, তা নিয়ে চলছে জল্পনা।
বিল গেটস ও মেলিন্ডার সম্পর্কের শুরুটা ছিল পেশাভিত্তিক। ১৯৮৭ সালে প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে মাইক্রোসফটে যোগ দিয়েছিলেন মেলিন্ডা। এরপর প্রায় সাত বছর প্রেম করেছিলেন তারা। এরপর নেন বিয়ের সিদ্ধান্ত। ১৯৯৪ সালে বিয়ে করেছিলেন তারা। ২০২০ সালের মার্চে তিনি মাইক্রোসফটের পরিচালনা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। তা সত্তে¡ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সত্য নাদেলার একজন প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। নিজের গেটস ভেঞ্চারের মাধ্যমেও তিনি অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। অন্যদিকে ২০১৫ সালে নতুন একটি সংগঠন দাঁড় করেছেন মেলিন্ডা। এর নাম পাইভোটাল ভেঞ্চার। এটি একটি স্বতন্ত্র অফিস।
বিল গেটস ও মেলিন্ডা গেটসের বিচ্ছেদের ঘোষণা বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানীয় দাতব্য সংস্থা ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’-এর জন্য প্রথমে একটা ভ‚মিকম্পের মতোই ছিল। তবে দুজনই আশ্বস্ত করেছেন, ফাউন্ডেশনের ওপর এ বিচ্ছেদের কোনো প্রভাব পড়বে না। পরে এক বিবৃতিতে ফাউন্ডেশনও জানায়, তারা দুজনেই ফাউন্ডেশনের কো-চেয়ারম্যান ও ট্রাস্টি হিসেবে থাকবেন। অর্থাৎ ফাউন্ডেশনে তারা এক থাকছেন। তবে সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ হয়তো এতটা সহজ হবে না।
এর আগে ২০১৯ সালে ২৫ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটান আরেক মার্কিন ধনকুবের ই-কমার্স জায়ান্ট আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস। সে সময় বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিবাহবিচ্ছেদের শর্তের ব্যাপারে একমত হন ম্যাকেঞ্জি বেজোস। জেফ বেজোসের সঙ্গে ডিভোর্সের পর তিনি পান ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের সম্পদ। এবার কি তার থেকেও ছাড়িয়ে যাবে গেটসদের বিচ্ছেদ চুক্তি। তা নিয়ে এখনো কোনো কিছু খোলাসা করেননি এই দম্পতি।
এদিকে গেটস ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফাউন্ডেশনের কৌশলগত বিষয়ের অনুমোদন, সব আইনি ইস্যু এবং সংস্থার সামগ্রিক দিকনির্দেশ নির্ধারণের জন্য একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবেন বিল গেটস ও মেলিন্ডা।
তবে ফাউন্ডেশনের ভবিষ্যৎ জানালেও বিল গেটস ও মেলিন্ডার যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তি কীভাবে ভাগ হবে বা বিচ্ছেদের চুক্তি কী হচ্ছে, সে বিষয়ে এখনো কোনো কথা প্রকাশ করেনি কোনো পক্ষই। বিচ্ছেদের পিটিশন আদালতের কাছে তারা এই বৈবাহিক সম্পর্ক মিটিয়ে ফেলার আবেদন জানান। সেই সঙ্গে বিচ্ছেদ চুক্তি অনুযায়ী ব্যবসায়িক স্বার্থ, দায়বদ্ধতা ও যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তি ভাগ করার বিষয়ে আবেদন জানিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে এখনো কিছু প্রকাশ করা হয়নি।
১৯৯৪ সালে বিয়ের ছয় বছর পর তারা যৌথভাবে গড়ে তোলেন দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নানামুখী কাজ করছে এই ফাউন্ডেশন। বিশ্বজুড়ে সংক্রামক রোগব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই ও শিশুদের টিকাদানে উৎসাহিত করতে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এ ফাউন্ডেশন প্রায় ৫৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, সচেতন, শিক্ষিত ও স্বাস্থ্যবান একটি বিশ্ব গড়ে তোলা এ সংস্থার প্রধান উদ্দেশ্য। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন প্রতিবছর প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে।
২০০৮ সালে পোলিও প্রতিরোধের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ৬৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার অনুদান দেন বিল গেটস। এর আগে এত অনুদান পায়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বর্তমানে মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ১৫ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। প্রয়োজনে তা ২৫ কোটি ডলারের উন্নীত করার আশ্বাস দিয়েছেন বিল গেটস।
এ ফাউন্ডেশনের অন্যতম দাতা আরেক ধনকুবের ওয়ারেন বাফেট। গত বছর তার প্রতিষ্ঠান বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের ২০০ কোটি ডলারের স্টক অনুদান দিয়েছেন তিনি। ১৯৯৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই ফাউন্ডেশনে ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার দিয়েছেন গেটস ও মেলিন্ডা দম্পতি। ২০১৯ সালের শেষ পর্যন্ত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী এই ফাউন্ডেশনের আকার ৪ হাজার ৩৩০ কোটি ডলার। এই আকার ৫ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য বিল গেটস ও মেলিন্ডা গেটসের।
‘কঠিন সময়’ পার করছি আমরা : জেনিফার গেটস
এদিকে বিল ও মেলিন্ডা গেটসের বিচ্ছেদের ঘোষণায় পুরো পরিবার কঠিন সময় পার করছে। সোমবার বিল ও মেলিন্ডা গেটসের বিচ্ছেদের ঘোষণার পর এই কথা বলেন তাদের মেয়ে জেনিফার গেটস। ২৫ বছর বয়সী জেনিফার গেটস ইনস্টাগ্রামে দেয়া একটি পোস্টে লিখেছেন, ‘এ পরিস্থিতিতে কীভাবে নিজের আবেগ সামলানো যায় এবং সেই সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সামলে রাখা যায়, তা নিয়ে এখনো আমি কাজ করছি। এতে আমাকে সুযোগ ও সমর্থন দেয়ায় আমি কৃতজ্ঞ।’ ইনস্টাগ্রামে জেনিফার আরো লিখেছেন, ‘এ বিচ্ছেদের বিষয়ে আমি ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু এটি মনে রাখবেন, আপনাদের সহানুভ‚তিশীল বক্তব্য ও সমর্থন আমার কাছে অনেক বড় বিষয়। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের চাওয়া বুঝতে পারায় সবার প্রতি ধন্যবাদ। আমরা এখন আমাদের জীবনের পরবর্তী পর্যায় নিয়ে কাজ করব।’
গেটস দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে বয়সে সবার বড় জেনিফার। তার ভাই রোরির বয়স ২২ বছর। আর ১৯ বছর বয়সী ফোয়েব সবার ছোট। তারা সবাই সিয়াটলে বড় হয়েছেন এবং পড়েছেন লেকসাইড হাইস্কুলে। জেনিফার ২০১৮ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক পাস করেন। এরপর তিনি নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাইয়ের ইকাহন স্কুল অব মেডিসিনে ভর্তি হয়েছিলেন। বিভিন্ন দাতব্যকাজেও সংশ্লিষ্ট আছেন জেনিফার গেটস। তিনি এখন শিশুরোগ নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে মানবসেবায় কাজ করতেই বেশি আগ্রহী জেনিফার। সাইডলাইন ম্যাগাজিনকে বলেছেন, ‘আমি বিশাল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি। আমি মনে করি, এই সুযোগ ও শেখার বিষয়টি কাজে লাগিয়ে আমার আগ্রহের বিষয়গুলো সন্ধান করব।’
রোরির জন্ম ১৯৯৯ সালে। জেনিফারের মতো তিনিও পড়াশোনা করেছেন ওয়াশিংটনের সিয়াটলের লেকসাইড হাইস্কুলে। এরপর ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোয়। লিঙ্গসমতা নিয়ে কাজের ব্যাপারে আগ্রহী ছেলে রোরি। এ কথা তার মা মেলিন্ডাই বলেছেন। ‘টাইম’ সাময়িকীতে তিনি লিখেছেন, রোরি ছেলে হিসেবে অসাধারণ। ভাই হিসেবে অতুলনীয়। অনেক কিছুই সে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে। ধাঁধা সে খুব পছন্দ করে। তবে রোরির যে বিষয়টি আমাকে গর্বিত করে, তা হলো, সে নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতন। যদিও রোরির নিজের পরিকল্পনা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। কারণ, সব সময় গণমাধ্যম এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন তিনি।
ছোট মেয়ে ফিবি অ্যাডেল গেটসের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে সম্প্রতি। পড়াশোনা করেছেন নিউইয়র্কের প্রফেশনাল চিলড্রেন স্কুলে। ব্যালে নাচের প্রতি বেশ আগ্রহ তার। ফলে পড়াশোনা করেছেন নিউইয়র্কের দ্য স্কুল অব আমেরিকান ব্যালেতে। এ ছাড়া পড়েছেন দ্য জুলিয়ার্ড স্কুলে। এ ছাড়া দাতব্য কাজের প্রতিও আগ্রহ রয়েছে তার। সূত্র : বিজনেস ইনসাইডার, ভক্স ডট কম, রয়টার্স, এনবিসি, নিউইয়র্ক পোস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন