সেখ গোলাম কুদ্দুস : বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র জীবনচরিত পর্যালোচনা করতে গিয়ে অনেকেই অনেকভাবে তাঁকে চিত্রিত করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে তিনি সৃষ্টির একমাত্র উপলক্ষ এই বিষয়টি মনে রেখেই তাঁকে মূল্যায়ন করতে হবে। অন্যথায় হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর অমূল্য জীবন ও আদর্শের অপমূল্যায়ন করা হবে। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলছেন। “হে নবী! আমি আপনাকে সৃষ্টি না করলে সমগ্র বিশ্বের কোন কিছুই সৃষ্টি করতাম না।”
সুতরাং যাকে উদ্দেশ্য করে এই পৃথিবী সৃষ্টি, তাঁকে ছাড়া এই পৃথিবীর অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা তাঁর শ্রেষ্ঠ রাসূল হওয়ার পক্ষে জ্বলন্ত প্রমাণ বহন করে।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল নবী-রাসূলদের তথা সমগ্র সৃষ্টি জগতের মধ্যে হুজুর (সা.)-কে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তিনিই ছিলেন সৃষ্টির একমাত্র লক্ষ্য। তাঁকে সৃষ্টি না করা হলে কিছুই সৃষ্টি হতো না, বিশ্ব নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সমগ্র বিশ্বের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। কেয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানব জাতির জন্য তিনিই একমাত্র পথ প্রদর্শক। তিনিই নবীগণের সর্দার। কালেমা তামজীদে তাঁকে ইমামুল মুরসালিন অর্থাৎ সমস্ত রাসূলগণের নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র নাম সকল আসমানি কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে প্রমাণিত হচ্ছে মহানবী (সা.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও সমগ্র মাখলুকাতের নবী। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ঘোষণা, “হে রাসূল আপনি বলে দিন, হে মানব জাতি, আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। (সূরা আরাফ-১৫৮)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে সারা বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন, আমি আপনাকে সারাবিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া-১০৭)। রাসূল (সা.) ছিলেন সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী। রাসূলের চরিত্র সম্পর্কে সূরা আল-কালাম-৪-এ মহান আল্লাহ বলছেন, “হে নবী নিশ্চয়ই আপনি অনুপম ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী। সূরা আহযাবে-২১ আয়াতে মহান আল্লাহ একইভাবে এরশাদ করেছেন, অবশ্যই তোমাদের জন্য মহানবী (সা.)-এর জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ। কোরআন পাকে বিভিন্ন সূরায় নবী করীম (সা.)-কে চেনার ও জানার জন্য পরিষ্কারভাবে বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখ আছে। রাসূল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় নিয়ে সংশয় প্রকাশ না করার জন্যও সতর্কতা করা হয়েছে (সূরা বাকারা-১৪৭)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন যে, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, আমাকে জান্নাতের পোশাক থেকে এক জোড়া পোশাক পরিধান করানো হবে, অতঃপর, আমি মহান আল্লাহ পাকের আরশের ডানপাশে দ-ায়মান হব, সমস্ত মানব জাতির মধ্যে ঐ স্থানে অন্য কোন মানুষ (এমন কি নবী-রাসূলগণও) দ-ায়মান হওয়ার সুযোগ পাবে না। (তিরমিযী)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি নবী-রাসূলদের নেতা, এতে আমার গর্বের কিছু নেই। আমি সর্বশেষ নবী এতেও আমার গর্বের কিছু নেই। আমি আল্লাহর দরবারে সর্বপ্রথম সুপারিশকারী। আমার সুপারিশই সর্বপ্রথম গৃহীত হবে। এতেও আমার গর্বের কিছু নেই।’ [তিরমিজী] [মিশকাত]
পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল এসেছেন, তাদের সংখ্যা এক লক্ষ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার। খাতামুন্নাবিয়্যীন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্বে যেসব নবী রাসূল এসেছিলেন, তারা এসেছিলেন নিজ কওমের বা নির্দিষ্ট কোন বিশেষ অঞ্চলের লোকদের হিদায়াত করার জন্য। তাঁরা সবাই ছিলেন জাতীয় নবী, কেউ বিশ্বনবী ছিলেন না। আর তাদের কারো উম্মতের উপর দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। কিন্তু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বশেষ নবী ও রাসূল হওয়ার কারণে তাঁর উম্মতের উপর দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলাম কোন জাতির জন্য নয়। কোন বিশেষ বর্ণের জন্য নয়। কোন বিশেষ অঞ্চলের জন্যও নয়। ইসলাম এসেছে বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য। তাই ইসলামের নবী বিশ্বনবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। আল্লাহ কোরআন পাকে ঘোষণা করেছেন, “তিনিই তাঁহার রাসূলকে পথ নির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন অপর সমস্ত দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করার জন্য। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।” (ফাত্হ-২৮)
মহান আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবিব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা অন্য কোন নবী-রাসূলকে দান করা হয়নি। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য :
১) সর্বপ্রথম মহানবী (সা.)-এর নূর সৃষ্টি করা হয়, ২) সর্বপ্রথম তাঁকে নবুয়াত প্রদান করা, ৩) মহানবী (সা.)-এর পবিত্র নাম আরশে মোবারকে লিপিবদ্ধ করা, ৪) তাঁর খাতিরেই বিশ্ব জগতের সৃষ্টি, ৫) সমস্ত আসমানী কিতাবে মহানবী (সা.)-এর শুভ আগমনের সুসংবাদ প্রদান, ৬) নবী করীম (সা.)-এর মিরাজ সংঘটিত হওয়া এবং আল্লাহর দীদার লাভ করা, ৭) নামাজের আযানে ও ইকামতে তাঁর নাম উচ্চারিত হওয়া, ৭) তাঁর মাধ্যমে নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি হওয়া, ৯) সর্বপ্রথম তাঁর সুপারিশ কবুল হওয়া, ১০) তাঁর শরীর মোবারক হতে খোশবু বের হওয়া ইত্যাদি উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। এসব বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল।
কোরআন শরীফে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন (সূরা বাকারা-২৫৩ আয়াতে এবং সূরা বনী ইসরাইল-৫৫) ঘোষণা করেছেন যে, “আমি তো নবীগণের কতককে কতকের উপর মর্যাদা দিয়েছি” স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা অনুযায়ী নবীদের মধ্যে নিশ্চয়ই কেউ শ্রেষ্ঠ আর তিনি হচ্ছেন তাজদারে মদিনা আহাম্মদ মোস্তফা (সা.)। বিশ্বনবী (সা.) অন্য নবীগণের নবী এবং তাঁরা সকলেই তাঁর অনুগামী, মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে অন্য নবীগণের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন “আর আল্লাহ যখন নবীগণের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন যে, আমি যা কিছু তোমাদের দান করেছি কিতাব ও জ্ঞান এবং অতঃপর তোমাদের নিকট কোন রাসূল আসেন, তোমাদের কিতাবকে সত্য বলে দেওয়ার জন্য, তখন সে রাসূলের প্রতি তোমরা ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। তিনি (আল্লাহ) আরো বলেন, তোমরা কি অঙ্গীকার করছ? নবীগণ বলল এবং এই শর্তে আমার পক্ষে কী অঙ্গীকার গ্রহণ করে নিচ্ছ? নবীগণ বললেন, আমরা অঙ্গীকার করছি।” (আল-ইমরান-৮১) এখানে স্পষ্টভাবেই বুঝা যাচ্ছে, হজরত নবী করীম (সা.)-এর প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ ঘটেছে। যিনি শ্রেষ্ঠ তাঁর প্রতিই তো আনুগত্যের প্রশ্ন আসে। আর তাই নবী করীম (সা.)-ই সর্বশ্রেষ্ঠ নবী।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি মনে করছি আর তা হলো মাইকেল এইচ হার্ট তার ‘দি হানড্রেড’ বইয়ে পৃথিবী সৃষ্টির থেকে আজ পর্যন্ত যেসব মনীষী জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী একশ’ জন ব্যক্তির জীবনী পর্যালোচনা করেছেন। এই একশ’ জন মনীষীর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের ক্রমানুযায়ী সর্বপ্রথম যার নামটি বিন্যাস করেছেন তিনি হচ্ছেন আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)। হার্ট তার পুস্তকের মুখবন্ধে লিখেছেনÑ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রভাবশালীদের তালিকায় আমি সর্বপ্রথম সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে মুহাম্মদ (সা.)-কে বেছে নিয়েছি। আমার এ পছন্দ কোন কোন ব্যক্তিকে বিস্মিত করতে পারে। আবার অনেকের মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে। কিন্তু ইতিহাসে তিনি মুহাম্মদ (সা.) একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি ধর্মীয় ও বৈষয়িক উভয় ক্ষেত্রেই সর্বাঙ্গীন সাফল্য লাভ করেছেন।
লেখক : সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন