শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মনোমুগ্ধকর পানি থৈ থৈ চলনবিল

প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সিরাজগঞ্জ থেকে শামীম শিরাজী : পানি নেই সিরাজগঞ্জের অনেক এলাকাতেই। এমনকি যমুনা তীরে গিয়েও চোখে পড়েনি পানির ওই রকম কোনো স্রোত বা তীব্রতা। কিন্তু সিরাজগঞ্জ-পাবনার বৃহত্তর চলনবিলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে শুধুই পানি আর পানি। যত দূর চোখ যায় পানি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। এ পানি নিয়ে বিল এলাকার মানুষের মনে নেই কোনো কষ্ট, দুঃখ, বেদনা কিংবা ক্ষোভ। আছে অন্যরকম ভাললাগা, আবেগ, উল্লাস-আনন্দ, উৎসবের আমেজসহ অর্থ উপার্জনের পথ। পানি তাদের বিনোদনের পথও সুগম করে। তাই পানিকেই আশীর্বাদ মনে করেন তারা। পানির মধ্যেও তারা খুজে পান জীবিকার নতুন সন্ধান। ৬ মাস কষ্ট শেষে ৬ মাস পানির সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে তারা। জলকে আপন করে নেওয়া এ এলাকায় যাবার সুবাদে এক নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিল। পানি বিপজ্জনক না হয়ে আশীর্বাদের কারণ হলো চলনবিলে ৬ মাস পানি থাকায় মৎস্য শিকারে অর্থ উপার্জন ঘটে বেশি মাত্রায়, এ সময় কর্মব্যস্ততা হ্রাস পাওয়ায় এবং যাতায়াতে সুবিধা থাকায় জামাই-জিরাত আত্মীয়-স্বজনে ভরে যায় গ্রাম। ঈদ উৎসবে যেমন মাটির টানে গ্রামে যায় মানুষ। তেমনি বর্ষায় পানির টানে বিলাঞ্চলে নানা আনন্দে মাততে নাড়ির টানে যায় তারা। এ অঞ্চলে নানারকম নৌকা বাইচ, চড়–ইভাতিসহ নানা আনন্দ উৎসবে আয়োজন করে তারা। এ উৎসবগুলোতে প্রচুর লোকের সমাগম ঘটে। হাটবাজার করা ও যাতায়াত ব্যবস্থা সুবিধায় পরিবহন খরচ কমে যাওয়ায় অনেকে নতুন বাড়িঘর তৈরি করেন। পাকা বাড়িঘর তৈরির জন্য ইট, বালি, সিমেন্ট, খোয়া, বিটোমিন ঘরে বসেই পাওয়া যায়। আবার বছরে সংসারের কেনাকাটা সারেন এ বর্ষা মৌসুমেই। বন্যার পানিতে নৌকায় বিভিন্ন পন্য বাড়ির ঘাটে বসে স্বল্প দামে পাওয়া যায়। মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল সংসারের যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন কেনা যায়, তেমনি বাড়িতে বসেই সংসারের নানা ধরনের অকেজো জিনিসপত্র লোহা-লক্কড়, প্লাস্টিক সামগ্রী, টিনসহ ভাঙা জিনিসপত্র বিক্রি করা যায় বাড়ির ঘাটে বসেই নৌকার ভ্রাম্যমাণ ভাংড়ি দোকানগুলোতেই। ঘটনার এখানেই শেষ নয়, এ বর্ষা মৌসুমেই পরিবহন খরচ বাচাতে নৌকা করে নিয়ে আসা হয় আগামী ইরি বোরো মৌসুমের জন্য বিভন্ন প্রকৃতি সার। সেইসাথে পানি নেমে গিয়ে কাদা তৈরি হলেও তারা বিরক্তবোধ না করে এই কাঁদা মাটিতে বিনা চাষে আবাদ করে রসুন, পিঁয়াজ, কালাই, সরিষাসহ হরেক রকম ফসল। বিস্তীর্ণ চলনবিল এলাকাজুড়ে সরিষা ফুলের অপরূপ দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য সৃষ্টি হলে তারা এ সরিষা খেতে মধু সংগ্রহের জন্য মাঠে মাঠে সারিবদ্ধভাবে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে হাজার হাজার মণ মধু সংগ্রহ করে বাড়তি অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হয়। তাই পানি হয় তাদের জন্য আশীর্বাদ।
উল্লাপাড়া থেকে সিএনজি অটোরিক্সায় লাহিড়ী মোহনপুর। এবার আর সড়কপথ নয়, যেতে হবে নৌপথে। কাছেই রেলপথের ধারে দহকুলা ঘাট। এখানে সারি সারি ইঞ্জিন চালিত নৌকা, ডিঙ্গি নৌকার বাহার।
নৌকাগুলো চলে এলংজানি, কোনাবাড়ি, দত্তপারা, সাতবিলা, চিনাধুকুরিয়া, নাদা, চকহরিপুর, হাজিপুর, নতুনগ্রাম, বলতৈল, চকপাড়া, গোনাইগাতী, কাইমকোলা, সরাতৈল, আঙ্গারু, নাদাসহ অন্তত ৩০টি গ্রামে। হরতালে কোনো তোয়াক্কা নেই তাদের। পানিপথে হরতালকরীরা বাধা সৃষ্টি করে না। ফলে অবাধ স্বাধীনতার জলপথে চলাচল করেন নৌ চালকেরা।
বেশির ভাগ নৌকাতে আবার সুন্দর করে ছই তোলা। রয়েছে মাইক। ঘাট ছাড়ার পরপরই শুরু হয় মাইকে গান। ভাড়াও অবিশ্বাস্যরকম কম (৫ কিলোমিটারে দূরত্বের ভাড়া ৫ টাকাই)। প্রত্যাশিত বাড়ির ঘাটেই নামা ও ওঠার সুযোগ। অপরপাশে রয়েছে আরও ২০ গ্রামে যাওয়ার আরএকটি নৌকা ঘাট। এখানকার নৌকা বামনগ্রাম, বঙ্কিরহাট, খাইরা, দত্ত খাড়–য়া, বলাইগাতি, আচলগাতি, কৈবতরগাতি, বিলপাশা, অকবহর, উধুনিয়া, দিঘলগাও, খাদুলী, পাঙ্গাশী এলাকায় চলাচল করে থাকে। এক একটি নৌকা ছেড়ে যাচ্ছে দশ থেকে পনের জন যাত্রী হলেই। এতো কম মানুষ আর কম ভারায় এ খাটুনি কেন জানতে চাইলে আকছেদ নামের এক নৌকা মালিক বললেন, এটা আমাদের আনন্দও। আর যারা বাইরে থেকে আসেন তারা এমনিতেই বেশি দেন। যাবার সময় কম হলে ফিরতি পথে ভাল যাত্রীসহ মালপত্র পেয়ে যাই। আর সকাল থেকে মাঝরাত্রি পর্যন্ত নৌকা চালাই। সব মিলে ভালই আছি।মাইক কেন জানতে চাইলে দুর্গম এলংযানী আটিয়ারপাড়ার গ্রামের এক বাসিন্দা নূরুল ইসলাম বলেন, মাইক বাজলে যারা কোথাও যেতে চান, তারা বুঝে যান নৌকা আসছে। বাড়ির পিছনের ঘাটে দাঁড়ায়। আমরাও তাদের তুলে নিয়ে আসি। আর মাইক নৌকা ভ্রমণের আন্দকেও বাড়িয়ে দেয়।’ দহকুলা ঘাটটা পেরুতেই বিস্তীর্ণ জলরাশির দেখা মিললো। মিল্ক ভিটার দুধ সংগ্রহের জন্য বেশি পরিচিত এ এলাকার বেশির ভাগ বাড়িতে বিদেশী জাতের গরু। আর গোবর সহজলভ্য হওয়ায় বায়ুগ্যাস প্লান্টও খুব বাড়ছে বলে জানালেন নৌকা যাত্রী খাদুলি গ্রামের মৃত মালা শেখের পুত্র আব্দুর রাজ্জাক (বিএ)। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে নৌকা আটিয়ারপাড়া বাজারে থামল কিছুক্ষণের জন্য। এ বাজারটি যেন এতদঞ্চলের জনসাধারণের মিলনস্থল। বাজার ঘেঁষেই এখানে রয়েছে একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয়। ছোট্ট এ বাজারটিতে কম দামে নদীর হরেক রকম মাছ পাওয়া যায়। বাজারের চায়ের দোকানগুলোতে সর মিশ্রিত খাঁটি দুধের চা যেন সবারই প্রিয়। একটু দূরে রয়েছে হাফেজিয়া মাদরাসা ও দাখিলা মাদরাসা। স্কুল মাঠে তৈরি হচ্ছে ব্র্যাকের ভাসমান শিক্ষা তরী। ৭টি শিক্ষা তরীর দুইটির কাজ শেষ হয়েছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সন্তানদের এ শিক্ষাতরী বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা সবার।
দুপুর না হতেই প্রচুর ডিঙ্গি (ছোট) নৌকার দেখা মিলল এলাকাজুড়ে। সবাই যেন ঘর ছেড়ে পানিতে ঘুরতে বের হয়েছে। এ এক বিরল দৃশ্য। আছে একেক দিন একেক পাশে নৌকা বাইচের আয়োজন। কোনোদিন বড় নৌকা আবার কোনোদিন ছোট নৌকা। স্থানীয়ভাবে আয়োজিত এসব প্রতিযোগিতার পুরস্কার বেশি দামি না হলেও আগ্রহ যেন অনেক বেশি। শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ঘুরতে গিয়ে পাবনা আর সিরাজগঞ্জ সীমান্তের কাছে একটি জায়গায় গিয়ে দুই পাশে অনেক দূরে গ্রামের দেখা মিললেও দক্ষিণাংশের কোন জনপদ চোখে পড়ছিল না। আর ঢেউ ছিল অনেকটা বড়। এ যেন আর একটি কক্সবাজার। পুরু পানির মধ্যে দু-একটি বাড়ি দেখা গেল। টিনের দোচালা, আর ছন সলার বেড়ার বাড়িকে চারপাশে ইটের গাঁথুনি দিয়ে রক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা। আবার কম পানিতে ডিঙ্গি নৌকায় বেড়াতে গিয়ে ভাবছিলাম স্থানীয় ষাটোর্ধ্ব আব্দুল রাজ্জাকের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘পানি আমাদের জন্য আশীর্বাদ। পানিকে কেন্দ্র করে এ ছয় মাস আমরা অনেক ভাল থাকি। এর মধ্যে যে কত কি আছে আমরা তা জানি।’ শুধু কোটি টাকার মাছই তারা ধরে থাকেন বলে জানান ডিঙি নৌকা চালানো এ মানুষটি। তিনি জানান, জুন থেকে মোটামুটি পানি আসে। থাকে নভেম্বর পর্যন্ত। এ সময় তাদের প্রধান আবাদ ধান, সরিসা আর মিল্কভিটার দুধ পৌঁছানো খুবই সহজ হয়। আর নৌকা মৌসুমে সব আত্মীয়স্বজন আসে। এখানকার সুস্বাদু মাছ সবার প্রিয়। আর হরতালের দিনগুলোতে এসব এলাকায় যেনো অঘষিত উৎসব। মিল্কভিটাসহ বেসরকারি কোম্পানিগুলো দুধ সংগ্রহ না করায় দুধের দাম কমে যায়। যাদের গরু নাই তারাও কম দামে দুধ যেমন খেতে পারে একইভাবে গরুওয়ালারা দই বসায়। এ যে আরেক উৎসব, তাই জামাই-জিরত ইষ্টি-কুটুমের আয়োজন হয় ব্যাপকভাবে। বড় পাশানি গ্রামের সুঠাম দেহের অধিকারী বলিষ্ঠ যুবক বাবু বলছিলেন, এত কম খরচে এ এলাকায় কোথাও যাওয়া যায় তা বলাই বাহুল্য। এখানে যেমন প্রায় সব ধরনের মাছ পাওয়া যায়, একই ভাবে দেশী মোড়র, রাজহাঁস পাওয়া যায়। আর কোথাও যেতে চাইলে শুধু বাড়ির সামনে দাঁড়ালেই হবে। ৫/১০ মিনিট পরপর নৌকার দেখা মিলবেই।’ দুর্গম দেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলেতে শিক্ষাদান কার্যক্রম ব্যহত হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমনটি হয় না। কারন এখানে নৌকা খুবই সহজলভ্য। আর শিক্ষকরাও স্থানীয়। এছারা শিক্ষা কর্মকর্তারা সরেজমিন অন্যসময় তেমন না আসলেও জুন-ডিসেম্বর সময়ে বেশী আসেন। আর মোবাইল ফোনে হরহামেশা শিক্ষকদের সঙ্গে কথা তো বলেনই। সেইসাথে বর্ষাকালে বিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকে না। এসময় প্রতিটি স্কুল থেকে মাসিক চুক্তিতে নৌকার সুব্যবস্থা করা হয়। ছাত্রছাত্রী নৌকায় যাতায়াত করে। আবার অনেক গ্রামের মেয়েরা একত্রে বৈঠা বেয়ে নিয়ে যায় নৌকা নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে থাকে। স্কুলগুলো দ্বিতলভবন হওয়ায় নিচে পানি জমে থাকলেও স্বাচ্ছন্দে ক্লাস করতে পারে শিক্ষার্থীরা।আবার রাজনীতেও এসব এলাকার মানুষ যেন আরও বেশি সচেতন। বাজারটিতে গিয়ে দেখা মিললো ঈদ শুভেচ্ছা দিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের ফেস্টুন। চায়ের দোকান আর নৌকায়তো রাজনৈতিক আলাপ রয়েছে। সব মিলে এ এলাকার মানুষগুলোকে মনে হয়েছে আন্তরিক। রাজনৈতিক মতানৈক্য থাকলেও তা সহিংসতা তেমনটা গড়ায় না। উৎসব আমেজেই তারা থাকতে যেন ভালবাসে। রাত হলে যেমনটা ওয়াজ ও জিকির মাহফিলের আয়োজন করে থাকে এখানকার মানুষ। তেমনি আবার বৈশাখ, বিজয় দিবসসহ বিশেষ দিনগুলোতে তারা মেতে উঠেন অন্যরকম আনন্দে। পানিতে তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা মনেই থাকে না। বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতাটির চরণটি যেন এখানে বাস্তব রূপ নিয়েছেÑ
‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট্ট সে তরী
আমার সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন