টঙ্গী থেকে মোঃ হেদায়েত উল্লাহ : ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় উদ্ধার অভিযান সপ্তম দিনে গড়িয়েছে। খোঁজ চলছে নিখোঁজ ১০ শ্রমিকের। গতকালও অগ্নিকা-ে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের খোঁজে অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন পরিবারের স্বজনরা। কারখানার পাশে দিনের পর দিন অপেক্ষা করছেন তারা। কেউ খুঁজছেন ছেলেকে, কেউ খুঁজছেন ভাইকে, কেউ আবার খুঁজে চলেছেন স্বামীকে। টঙ্গী থানার ওসি ফিরোজ আলম তালুকদার ইনকিলাবকে বলেন, সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ধ্বংসস্তূপ অপসারণে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সেখানে নতুন কোনো লাশ পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান জানান, গত শনিবার সকালে অগ্নিকা-ের পর
সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে এখনও উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ধ্বংসস্তূপ সরানো হচ্ছে এবং নিখোঁজদের উদ্ধার তৎপরতা চলছে। এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ জনে।
গতকাল শুক্রবার ট্যাম্পাকোর আশপাশ ঘুরে দেখা যায়, বিস্ফোরণে অগ্নিকা-ের সপ্তম দিনেও চলছে অভিযান। এ অভিযানে কখন যে নিখোঁজ প্রিয়জনের সন্ধান মিলবে তার অপেক্ষায় ছবি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন স্বজনরা। এখন পর্যন্ত নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে ১০ জন। বাতাসে কারখানার ভেতর থেকে বের হচ্ছে পোড়া লাশের গন্ধ।
নিখোঁজ রিয়াদ হোসেন মুরাদের (২৩) খোঁজে ছবি নিয়ে অপেক্ষায় কারখানার পাশে দাঁড়ানো তার বোন তানিয়া আক্তার ও বাবা মো. আবু তাহের। তিনি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানার শিবপুর এলাকার বাসিন্দা।
আবু তাহের জানান, তিনি টঙ্গীর আরিচপুর এলাকায় হাসিনা নামে একজনের বাড়িতে সপরিবারে ভাড়া থেকে ওই এলাকায় রং মিস্ত্রির কাজ করেন এবং তার ছেলে রিয়াদ ট্যাম্পাকো কারখানায় হেলপার হিসেবে কাজ করতেন। ঘটনার আগের দিন শুক্রবার রাত ১০টার দিকে রিয়াদ কারখানায় কাজে যোগ দেন। পরের দিন সকাল ৬টার দিকে কারখানা থেকে বের হওয়ার সময় বিস্ফোরণে অগ্নিকা-ের পর থেকে তিনি নিখোঁজ হন। তার মতো প্রতিদিন ভাই জহিরুলের ছবি হাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় রয়েছেন আবু তাহেরের বোনের মেয়ে মরিয়ম।
গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের অভিযোগে তিতাসের তদন্ত কমিটি
টঙ্গীতে ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় গ্যাস লিকেজ থেকে অগ্নিবিস্ফোরণ এবং এ থেকে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, এমন অভিযোগ উঠার পর তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মীর মশিউর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার ওই কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে তিতাসের ঢাকা মেট্রো উত্তরের মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) প্রকৌশলী রানা আকবর হায়দারীকে প্রধান এবং ঢাকা মেট্রো-৪-এর উপ মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী বাসু দেব সাহা এবং তিতাসের উপ-ব্যবস্থাপক (ভিজিলেন্স বিভাগ) শহীদ হোসাইন সোহাগকে সদস্য করা হয়েছে। এই তদন্ত কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
গত শনিবার সকালে ট্যাম্পাকো কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনায় গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ৩৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে অন্তত শতাধিক শ্রমিক। আর এখনো নিখোঁজ রয়েছে ১০ জন।
উল্লেখ্য, দুর্ঘটনার পর শনিবার বিকেলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বয়লার পরিদর্শক ইঞ্জিনিয়ার শরাফত আলী ট্যাম্পাকো কারখানা পরিদর্শন শেষে দাবি করেছেন, বয়লার নয়, গ্যাস লাইন লিক হয়ে টাম্পাকো কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, টাম্পাকো কারখানায় দুটি বয়লার রয়েছে। এগুলো আগামী ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত নবায়ন করা আছে।
কারখানার বয়লার অপারেটর ইনচার্জ ইমাম উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের কোনো আশঙ্কাই নেই। আমরা বয়লার রুমে গিয়ে দেখেছি বয়লার দুটি এখনও অক্ষত আছে। তবে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে কারখানায় গ্যাস লাইনে লিকেজ সৃষ্টি হয়েছিল। এ ব্যাপারে গ্যাস অফিসে অভিযোগও দেওয়া হয়েছিল। গ্যাস লিকেজের কারণে হয়তো অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটতে পারে।
কারখানায় সরকারিভাবে গ্যাস ব্যবহারের অনুমোদন ছিল ১০ পিএসআই। কারখানার বয়লার এবং জেনারেটর গ্যাসের সাহায্যে চলত।
আহত শ্রমিকের বক্তব্য
গুরুতর আহত মেশিন অপারেটর মনোয়ার হোসেন জানান, শনিবার সকাল ৬টার শিফটে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য কয়েক মিনিট আগেই কারখানায় প্রবেশ করি। ভেতরে ঢুকেই শো-শো শব্দ শুনতে পাই। টিফিনবক্স আলমারিতে রেখে খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে শ্রমিক মিলনকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? সে বলল, গ্যাস পাইপ লিকেজ। গ্যাস অফিসে জানানো হয়েছে, এখনও কেউ ঠিক করতে আসেনি। এরপর ভয়ঙ্কর শব্দ, ধপাস করে পড়ে গেলাম। চিৎকার করে বলতে থাকি আমাকে বাঁচাও। দুই পায়ে মারাত্মকভাবে আহত স্থানীয় আবেদা মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তার সাথে আরিফ ইসলাম ও আব্দুর রাজ্জাক নামে অপর দু’জন চিকিৎসাধীন রয়েছে। আরিফ, রাজ্জাক ও মনোয়ার বলেন, রাতে ৭০-৭৫ জন কাজ করছিল। সকালের শিফটে আসা মিলে প্রায় দেড়শ’ জন তখন ভেতরে ছিল। যারা রাতে ডিউটি করছিল তারা ভেতরে ছিল। আর আমরা কেবল গেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকি। গ্যাস এমন ভয়ংকর হতে পারে তা আমাদের জানা ছিল না। এ কারখানায় তিন শিফটে মোট সাড়ে চারশ’ কর্মী কাজ করেন বলে জানান ২২ বছরের কর্মী রংপুরের গঙ্গাচড়ার মনোয়ার। সকাল ৬টার শিফটে যোগ দেওয়ার জন্য কয়েক মিনিট আগে প্রবেশ করেন দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার বিজুল সরকারপাড়ার আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, কারখানার ইঞ্জিনিয়ার আনিসুর রহমান গ্যাস লাইনের লিকেজের বিষয়ে নিরাপত্তা কর্মী জয়নাল আবেদীন, জাহাঙ্গীর, সফিকুল ইসলাম, ইদ্রিস, শ্রমিক আল মামুন, নয়ন, জাহিদুল তাদের কথা বলছিলেন। এ সময় আমি ভেতরে ঢুকে নিচতলায় কেবল মেশিন পর্যন্ত গেছি, এরপর আর কিছুই বলতে পারি না। রাজ্জাকের ডান পা, বাম কাঁধে আঘাত লেগেছে বলে জানান চিকিৎসকরা। তিনিও কাজ করছেন গত ৬ বছর। রাতের শিফট শেষ করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আহত হয়েছেন কর্মী আরিফ ইসলাম। তিনি জানান, ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কারখানাটির মালিক সিলেট থেকে নির্বাচিত বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ মকবুল হোসেন।
নগদ লক্ষাধিক টাকা উদ্ধার
টঙ্গী থানা পুলিশ জানায়, ওই কারখানার নিখোঁজ ১০ শ্রমিকের সন্ধানে গত রোববার বিকাল থেকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তল্লাশি অভিযান চলছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও ধ্বংসস্তূপ সরাতে কাজ করছেন। পুলিশ জানায়, ‘কারখানা থেকে উদ্ধার করা খাট, ডাইনিং টেবিল, চেয়ারসহ বিভিন্ন মালামালের তালিকা করেছে পুলিশ। এর মধ্যে এক লাখ দুই হাজার ৭৫৫ টাকা এবং সাত হাজারের মতো পোড়া টাকাও রয়েছে।’
প্রতিশ্রুত অনুদান পায়নি অনেকে
এদিকে প্রতিশ্রুত অনুদানের টাকা পায়নি নিহত রিকশাচালক আব্দুর রাশেদের পরিবারসহ ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে। রাশেদের লাশ ময়মনসিংহে তার বাড়িতে নিতে ধার করতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার এক স্বজন। সেদিন বিস্ফোরণের পর ওই কারখানায় আগুন ধরে যায় এবং ছাদের একটি অংশ ধসে পড়লে পাশের রাস্তায় কয়েকজন চাপা পড়েন। প্রথম দিনের উদ্ধার অভিযানে যাদের লাশ উদ্ধার করা হয়, তাদের মধ্য ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের গোলাকান্দার সজিম উদ্দিনের ছেলে আব্দুর রাশেদও ছিলেন।
তার প্রতিবেশী আকবর আলী জানান, তিন ভাই ও দুই বোনের সংসারে রাশেদই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্যনক্ষম ব্যক্তি। স্ত্রী জেবুন্নাহার ও তিন বছরের ছেলেকে গ্রামের বাড়িতে রেখে টঙ্গীর জামাই বাজার এলাকায় রিকশা চালাতেন রাশেদ। আকবর আলী বলেন, শনিবার সকালে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ এলাকার হানিফ মিয়ার দুই মেয়ে রোজিনা (২১) ও তাহমিনাকে (১৮) রিকাশায় নিয়ে ট্যাম্পাকো কারখানার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন রাশেদ। এ সময় বিস্ফোরণ হলে কারখানার ছাদের নিচে তারা তিনজন চাপা পড়ে। উদ্ধার করে টঙ্গীর হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক সবাইকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে তাদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। রোববার সেখান থেকে লাশ হস্তান্তর করা হয় পরিবারের কাছে।
রাশেদের বড় বোন বেদেনা আক্তার বলেন, হাসপাতাল থেকে গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে লাশ নেওয়ার সময় কারখানার মালিক পক্ষ আট হাজার টাকা দিয়েছে। লাশ বহনের জন্য জেলা প্রশাসনের ঘোষিত ২০ হাজার টাকা বা মালিকপক্ষের প্রতিশ্রুত ২৫ হাজার টাকা তারা পাননি। লাশ নিতে খরচ হইছে নয় হাজার টাকা। এক হাজার টাকা ধার করে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারকে দিছি। কারখানার মালিকের লোক বলছে, রাশেদ তো কারখানার কেউ নয়, বাইরের রিকশাওয়ালা। তাই আর কোনো টাকা দেবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) মো. মামুন শিবলী জানান, তারা নিহত একজনের পরিবার এবং আহত ১৩ পরিবারকে সহায়তার টাকা দিয়েছেন। বাকিদের পরিবারের কেউ সহায়তার জন্য না আসায় তাদের অর্থ দেওয়া যায়নি বলে জানান তিনি। মামুন শিবলী বলেন, যারা এখনও সহায়তার অর্থ পাননি, তারা পরিচয়পত্র এবং চেয়ারম্যান/মেয়রদের প্রত্যয়নপত্র নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে যোগাযোগ করলে টাকা বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
রানা প্লাজার চেয়েও বেশি ধ্বংসস্তূপ
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএসএম মাহমুদ হাসান বলেন, ‘ট্যাম্পাকোতে রানা প্লাজার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসস্তূপ। এই ধ্বংসস্তূপ সরাতে মাসের বেশি সময় লাগতে পারে। এমনকি দুই মাসও লাগতে পারে। এটা বলা মুশকিল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন