স্টাফ রিপোর্টার : গুলশানের জঙ্গি হামলার পর কূটনীতিক এবং বিদেশীদের নিরাপত্তায় একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। কয়েক স্তরের নিরাপত্তার ঘেরাটোপ, কয়েকশ সিসি ক্যামেরা স্থাপন, নিরাপত্তার জন্য আনসার সদস্য এবং বুলেটপ্রুফ গাড়ি এমনকি দেয়াল তৈরি করে কূটনৈতিক জোনকে ঘিরে ফেলার প্রস্তাবও আলোচনার টেবিলে। এছাড়া দফায় দফায় কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করে সরকার, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। কূটনীতিকদের নিয়ে ঈদের আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
কূটনীতিকরা বলেন, সারা দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে এবং গোটা সমাজ অরক্ষিত থাকলে কূটনীতিকদেরও ঝুঁকি থেকে যায়। বরং বৈঠকে বিদেশী কূটনীতিকরা তাদের নিরাপত্তায় আরও কিছু পদক্ষেপের সুপারিশ করেন। সুইডেনের রাষ্ট্রদূত জোহান ফ্রিসেল এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, নিরাপত্তা আরও জোরদারে কূটনীতিকরা নতুন কিছু সুপারিশ করেছেন। আমরা মনে করি, শুধু কূটনীতিক কিংবা বিদেশী মিশনের নিরাপত্তাই নয়, বরং গোটা বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।
তবে বিদেশী কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে কী কী সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি পররাষ্ট্র সচিবও। তবে বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, বিদেশী কূটনীতিক ও তাদের মিশনের নিরাপত্তায় সরকার কূটনীতিকদের আর্মার্ড ভেহিক্যাল ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। বিদেশী মিশনগুলো নিজেদের উদ্যোগে এ ধরনের বুলেটপ্রুফ গাড়ি আমদানি করে ব্যবহার করতে পারবে। পাশাপাশি বিদেশী মিশন ও কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় ভাড়ার বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে সশস্ত্র আনসার নিতে পারবে। একই সঙ্গে বিদেশী কূটনীতিকরা নিরাপত্তার প্রয়োজনে গাড়িতে হলুদ নম্বর প্লেট ব্যবহার করতে না চাইলে সরকারের পক্ষ থেকে সাদা নম্বর প্লেট সরবরাহ করা হবে।
বাংলাদেশে বিদেশিদের নিরাপত্তায় আস্থাহীনতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমদ বলেছেন, বিদেশীদের জন্য দৃশ্যমান নিরাপত্তা আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। শুধু জঙ্গি দমন করলে আস্থা আসবে না। আইনের শাসন, সবার অংশগ্রহণের নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে হবে।
এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদও সবার আগে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে বলে মত দেন। তিনি বলেন, ১৬ কোটি মানুষকে একেকজন করে পুলিশ দিয়ে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়। পুলিশ দিয়ে যতই নিরাপত্তার দেয়াল তৈরি করা হোক জঙ্গি সংগঠনগুলো সক্রিয় থাকলে হামলার আশঙ্কা থেকেই যায়। যে যেখানে থাকুক সেখানে যাতে জঙ্গি হামলা না হয়, সেজন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর মূল উৎপাটন করতে হবে।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে বাড়তি নিরাপত্তা চাহিদা দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঢাকাস্থ অধিকাংশ দূতাবাস এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের কূটনৈতিক স্থাপনায় সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সিলেটে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্রিটিশ হাইকমিশনের অফিস বন্ধ দেয়া হয়েছে। তবে এটি নিরাপত্তাজনিত কারণ না অন্য কোনো কারণে করা হয়েছে এ ব্যাপারে ব্রিটিশ হাইকমিশনের পক্ষ থেকেও কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) গুলশান-বারিধারার চারপাশ ইটের দেয়াল অথবা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা করছে বলেও জানা গেছে। গুলশান-বারিধারা এলাকায় অবস্থিত কূটনৈতিক মিশনগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই এ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে মনে করেন পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক আহমেদ।
প্রসঙ্গত, গুলশানে জঙ্গি হামলার পর গত জুলাই মাসে নিরাপত্তাজনিত কারণে বাংলাদেশে সাময়িকভাবে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সব অফিস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশের পরিচালক বারবারা উইকহ্যাম এক বিবৃতিতে বলেন, আমরা লক্ষ করেছি, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং তাদের মধ্যে আতঙ্ক দিন দিন বাড়ছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলে যারা কাজ করেন এবং এখান থেকে যারা সেবা গ্রহণ করে থাকেন তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
শুধু তাই নয়, সেসময় ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বাতিল করেন বিদেশীরা। কিছু কর্মকর্তা হঠাৎ করে নিজ দেশে চলে যান। কূটনৈতিক মিশনগুলো তাদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাবধানে চলাচল করার নির্দেশনা দেয়। কোনো কোনো দেশ বাংলাদেশে ভ্রমণ সতর্কতাও দেয়। সেসময় গুলশানের কূটনৈতিক জোনের অনেক হোটেল, শিক্ষা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। পাশাপাশি যানবাহন ও সাধারণ মানুষের চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। যেসব ব্যবস্থা এখনো বলবৎ রয়েছে। তারপরও আশঙ্কামুক্ত হতে পারছে না বিদেশীরা। খোদ প্রতিবেশী ভারতের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে নিরাপত্তার জন্য তাদের দূতাবাসে বিজিবি মোতায়েনের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন