বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশ বিপর্যয়

লবণাক্ততা রোধে নেয়া হচ্ছে নানা প্রকল্প ফসলি জমি নষ্ট হওয়ায় এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন অনেকে

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ১৮ মে, ২০২১, ১২:০১ এএম

আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবের ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলার জনজীবন এখন বিপর্যস্ত। এ অঞ্চলের বিপর্যয়ের মূল কারণ লবণাক্ততা। এরমধ্যে সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী ও বরগুনা লবণাক্ততার পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে। লবণাক্ত জমিতে ফসল হচ্ছে না। ফসলি জমি লবণ পানি ঘের বিস্তৃত হচ্ছে। ফলে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে অসংখ্য পরিবার। ফসলি জমি নষ্ট হওয়ায় অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ওই অঞ্চলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ভয়াবহ হুমকির মুখে বলে পরিবেশবিদরা মনে করছেন। সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা ছাড়াও বরিশালসহ আরও কয়েকটি জেলার পুকুর, ডোবা-নালা, নদী ও খাল-বিলের পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। জার্মান ওয়াচের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। আর এই বিপর্যয়ের যে ক’টি কারণ আছে তার মধ্যে লবণাক্ততা অন্যতম।
দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততা রোধে সরকারের শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-তে বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেন, আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব অর্থাৎ পরিবেশ বিপর্যয় রোধে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক প্রকল্প শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যানে গ্রহণ করা হয়েছে। লবণাক্ততা, খরা, বন্যা প্রাকৃতিক এসব চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় রেখে সেভাবেই ২০৩০ সাল নাগাদ প্রথম ধাপে ৮০টি প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো পর্যায়ক্রমে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্য দিয়েই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাদুপানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে। সমাধান হবে লবণাক্ততা, প্রকট খরা ও জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগও।
দেশে এমন অনেক জেলা আছে যেখানকার নদী-খালে ছয়মাস পানি থাকে, বাকি ছয়মাস শুকনো মৌসুম। ওই সময় ফসলি জমি ফেটে চৌচির হয়ে থাকে। আবার সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৪০টি উপজেলাজুড়ে আছে বিস্তৃত ভাটি অঞ্চল। একই দেশে এমন পার্থক্যের জন্য আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবকেই দায়ী করা হয়। এসব জেলা নিয়েও ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা রয়েছে ব-দ্বীপ পরিকল্পনায়।
ইতোমধ্যে আবহাওয়ার পরিবর্তন, উষ্ণায়ন ও পরিবেশ রক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের অবস্থান ও পদক্ষেপ বিশ্বসমাজে প্রশংসিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড’-এর বরাদ্দ আরও বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিও এ মহাপরিকল্পনায় স্থান পেয়েছে।
ব-দ্বীপ হিসেবে বাংলাদেশের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑ ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা। বৃষ্টিপাতের তারতম্য। বন্যার আশঙ্কা। খরা মোকাবিলাও একটি চ্যালেঞ্জÑ মূলত কৃষিজনিত খরা। নদীভাঙন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা ও পরিমাণ বাড়তে পারেÑ জলাবদ্ধতা, পলি জমা। আন্তঃদেশীয় নদী ব্যবস্থাপনা। ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-সাল এ বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জগুলো মেকাবিলার কৌশল কাঠামো নির্দিষ্ট করা হয়েছে তিনটি। প্রথমটি হচ্ছেÑ জাতীয় পর্যায়ের কৌশল। এর একটি হচ্ছেÑ বন্যার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা আর অন্যটি স্বাদুপানির ব্যবস্থাপনা। দ্বিতীয়ত- ৬টি হটস্পটের জন্য কৌশল কাঠামো। এগুলো হচ্ছেÑ প্রথম দফা ২০৩০ সাল, ২য় দফা ২০৪১ থেকে ২০৫০, ২০৬১ থেকে ২০৭১, ২০৮০, ২০৯১ এবং চূড়ান্ত ধাপটি হচ্ছে ২১০০ সাল। সর্বশেষ তৃতীয়টি হচ্ছেÑ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয় ব্যবস্থাপনা কৌশল। এর মধ্যে রয়েছেÑ টেকসই ভূমি ব্যবহার এবং স্থানিক পরিকল্পনা, কৃষি খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, এবং জীবিকা, আন্তঃদেশীয় পানি ব্যবস্থাপনা, গতিশীল অভ্যন্তরীণ নৌ-ব্যবস্থাপনা এবং সমুদ্র অর্থনীতি ও নবায়নযোগ্য শক্তি।
এ ছাড়া সরকারের ১০০ বছরের প্রণীত ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার জাতীয় কৌশলপত্রে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এর জন্য যেসব কার্যক্রম নিতে হবে সেগুলো হচ্ছেÑ বেসিন ওয়াইড পদ্ধতি অনুসরণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। প্রধান নদীগুলোয় নতুন সেচ প্রকল্প গ্রহণ এবং স্থানীয় পর্যায়ের বিদ্যমান জলাধার যেমন ডোবা, বাওর, পুকুর পুনঃখনন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে পানি সংরক্ষণ এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ। সম্ভাব্যতা জরিপের মাধ্যমে রাবার বাঁধ নির্মাণের জন্য স্থান নির্বাচন। (বর্তমানে ৩৫০টি রাবার বাঁধ কার্যকর রয়েছে)। আঞ্চলিক নদনদীগুলোর প্রবাহ বাড়াতে পদক্ষেপ গ্রহণ। নদী ও জলাভূমি পুনরুদ্ধারে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব প্রদান। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপ ও তা সংরক্ষণ। নগর এবং গ্রামীণ নদীতে স্বাদুপানির প্রবাহ বাড়ানো ও সার্বিকভাবে দূষণমুক্ত রাখা।
অন্যদিকে সরকারের ডেল্টা প্ল্যানে আন্তঃদেশীয় পানি ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি কৌশলের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑ উজানের নদীগুলো থেকে পানি সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সে অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা। উজানের পানি প্রবাহের বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় রেখে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে প্রয়োজনে দেশের অভ্যন্তরে সম্ভাব্য বাঁধ বা ব্যারেজ নির্মাণের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা। পানিসংক্রান্ত কূটনীতির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান এবং সংঘাত প্রতিরোধ করা। তিস্তার পানিবণ্টন সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদন তৎপরতা অব্যাহত রাখা। চাহিদাভিত্তিক যৌথ নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ। পানিসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে তৃতীয় পক্ষকে (বহুপক্ষীয় বা দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বা দেশ) সম্পৃক্তকরণ এবং অববাহিকাভিত্তিক বন্যার পূর্বাভাস পদ্ধতির উন্নয়ন।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ অনুমোদন পায়। এর আগের ৪৭ বছরে দেশে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, কৃষি উন্নয়নে বহু পরিকল্পনার পরও সরকার আগামী ১০০ বছরের জন্য ব-দ্বীপ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ পরিকল্পনার আওতায় আছে সারা দেশ। দেশের নদ-নদী, জলাভূমি, মাটি, পাহাড়, সমতল, হাওরসহ যাবতীয় প্রাকৃতিক ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করে এ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি চূড়ান্ত করার আগে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবেশ-প্রতিবেশ, বিনিয়োগ, অর্থায়ন ইত্যাদি বিষয়ে ২৬টি বেইজলাইন সমীক্ষাও করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী সভাপতি ড. আব্দুল মতিন বলেন, পরিবেশ বিপর্যয় রোধের বিষয়টিকে সরকার গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে বলে মনে হয় না। বিভিন্ন পরিকল্পনা ও প্রকল্প নেওয়া হলেও তা খুব একটা কার্যকর হয় না। কিছু প্রকল্প নেওয়া হলেও সেগুলোতে অনিয়ম দুর্নীতি হয় বেশি। ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এ লবণাক্ততা ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধসহ আরও যেসব পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে তা বাস্তবায়ন কতটা হবেÑ সেটাই দেখার বিষয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন