স্টালিন সরকার : দেশে এতিম এবং লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থেকে বিনা খরচে কওমী মাদরাসায় পড়–য়া তালেবে ইলমের প্রকৃত সংখ্যা কত সে পরিসংখ্যান নেই। তবে সমাজের গরিব, সুবিধাবঞ্চিত, বাপ-মাহারা প্রায় ৪০ লাখ শিশু-কিশোর কওমী মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থেকে পড়াশোনা করে। তাদের থাকা-খাওয়া, বই-পুস্তক, খাতা-কলম, কাপড়-চোপড় প্রায় সবকিছুই বহন করে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। দেশের দানশীল ব্যক্তি, আলেম ও বিত্তবানদের অর্থে গড়ে ওঠা এসব মাদরাসার প্রধান আয়ের উৎস ঈদুল ফিতরের যাকাত ও ঈদুল আজহার কোরবানির চামড়া বিক্রির অর্থ। বিভিন্ন দান ও চাঁদার মাধ্যমে কিছু অর্থ এলেও মূল অর্থ দুই ঈদে আসে। কিন্তু এবার চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেট ও তুঘলকি কা-ে মাদরাসাগুলোর গরিব-দুঃখী ছাত্ররা বিপাকে পড়বে। এ আশঙ্কা করে একজন আলেম জানান, কওমী মাদরাসা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় পরিকল্পিতভাবে চামড়া নিয়ে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো কিনা এ নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে। শুধু চামড়ার টাকা না পাওয়া নয়, অনেক মাদরাসার ছাত্ররা নিজেরাই চামড়া কিনে বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানের জন্য আয় করেন। সে অর্থ ফ্রি-পড়–য়া ছাত্রদের পিছনে ব্যয় করা হয়। এবার গ্রামগঞ্জের অনেক মাদরাসার ছাত্ররা চামড়া কিনে বিক্রি করতে গিয়ে লোকসান দিয়েছে। এতে ওইসব মাদরাসা কর্তৃপক্ষই শুধু নয়, লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থেকে লেখাপড়া করা ছাত্ররা বিপদে পড়বে।
দেশে প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ লাখ পশু কোরবানি হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ত্রিশ লাখ গরু। এসব গরুর চামড়ার মূল্য হাজার হাজার কোটি টাকা। এ টাকার বড় অংশ মূলত সমাজের গরিব, অক্ষম বৃদ্ধ, মিসকিনদের অধিকার। কোরবানির চামড়া সংগ্রহের অর্থে পরিচালিত হয় এ দেশের অধিকাংশ গরিব-অসহায়দের জন্য প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দেশে কওমী মাদরাসার প্রকৃত সংখ্যা জানা না গেলেও প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার কওমী মাদরাসায় লিল্লাহ বোর্ডিং রয়েছে। ওই সব লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থেকে মাদরাসাপড়ুয়া গরিব শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনায় কোরবানির চামড়ার দান করা অর্থ বড় ধরনের সহায়ক। দেশের প্রায় সবকটি কওমী মাদরাসায় কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের অর্থে পরিচালিত হয়ে থাকে। আবার মাদরাসার ছাত্ররা কম পয়সা চামড়া কিনে বিক্রি করে মাদরাসা পরিচালনার অর্থ সংগ্রহ করেন। এ অর্থ সংগ্রহে ব্যাঘাত ঘটলে মাদরাসাগুলোর বার্ষিক খরচ পরিচালনায় বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। এ বছর কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে ট্যানারি মালিকদের চামড়া সিন্ডিকেট ও কওমী মাদরাসাগুলো চামড়ার সঠিক মূল্য না পাওয়ায় রাজধানীসহ দেশের সবকটি কওমী মাদরাসা বড় ধরনের অর্থ সঙ্কটে পড়বে। লালবাগ মাদরাসার এক সিনিয়র শিক্ষক জানান, প্রতিবছর মাদরাসার পরিচালনার খরচের বাজেট করা হয়। বাজেটের সে অর্থ কোথা থেকে আসবে তাও নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এবার যেভাবে সি-িকেটের মাধ্যমে ট্যানারি মালিকরা চামড়ার অর্থ গলাধঃকরণ করলেন তাতে মাদরাসাগুলো চরম আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। ওই শিক্ষকের মতে, চামড়ার মূল্য না পাওয়া লোকসানের কারণে মাদরাসাগুলোর লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে দান-খয়রাতের পরিমাণও কমে যাবে। বিনা মূল্যে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনাও অনেক সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। যারা লিল্লাহ বোর্র্ডিংয়ে থেকে পড়াশোনা করছে তারা যদি বাড়িতে ফিরে যায়, তাহলে সমাজে নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। যদিও সেটা হবে না বলে মনে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে গ্রামে কওমী মাদরাসায় যারা পড়ে তাদের অধিকাংশই সমাজের সুবিধাবঞ্চিত। অধিকাংশের মা-বাবা নেই। যাদের বাবা-মা রয়েছে তাদের অধিকাংশই পড়াশোনার খরচ বহন করতে পারেন না। এসব শিশুর পড়াশোনার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালন করছে না। অথচ সমাজের কিছু পরোপকারী ও দানশীল মানুষ ওই সব এতিম-গরিব দুস্থ শিশু-কিশোরদের মাদরাসায় লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে রেখে পড়াশোনা করাচ্ছে। গরিব এতিমদের খাবারেও থাবা বসিয়েছে কিছু অর্থবান মানুষ।
কোরবানির চামড়ার ওপর শকুনের থাবায় চরম আর্থিক দুর্দশায় পড়তে যাচ্ছে সামাজিক ভাবে গড়ে ওঠা লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থাকা মাদরাসা পড়–য়া সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা। এবার পর্যাপ্ত চাহিদা থাকা সত্ত্বেও চতুর্মুখী সিন্ডিকেটের কবলে ফেলা হয়েছে দেশের চামড়ার বাজার। এটা হয়েছে কার্যত পরিকল্পিতভাবেই। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চামড়া কেনা ক্ষুদ্র মৌসুমি ব্যবসায়ী এবং চামড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থের ভাগীদার হতদরিদ্র মানুষ, এতিম, ফকির-মিসকিন ও বিনে পয়সায় থাকাখাওয়াসহ মাদরাসা পড়–য়া শিক্ষার্থীরা। প্রতিবছর চামড়ার মোট চাহিদার সিংহভাগের যোগান আসে কোরবানি ঈদে। একই সঙ্গে দেশের হতদরিদ্র মানুষ, এতিম ও মিসকিনদের সারা বছরের অর্থের বড় যোগানও আসে কোরবানির ঈদের চামড়া থেকে প্রাপ্ত সহায়তার মাধ্যমে। বিপুল সংখ্যক মাদরাসা ঈদের চামড়ার টাকায় পরিচালিত হয়। কিন্তু চতুর্মুখী সিন্ডিকেটের কারণে এসব মাদরাসা ছাত্র, এতিম ও মিসকিনরা তাদের ন্যায্য হক থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এমনটাই মনে করছেন মাদরাসাগুলোর পরিচালক ও সংশ্লিষ্টরা। তবে একটি মাদরাসার শিক্ষক বলেন, চামড়া সি-িকেট পরিকল্পিত ভাবে কওমী মাদরাসা শিক্ষার নিয়ন্ত্রণের প্রথম পদক্ষেপ কিনা বোঝা যাচ্ছে না। কারণ সরকারের সুবিধাভোগী কিছু বুদ্ধিজীবী সব সময় কওমী মাদরাসার বিরুদ্ধে বিষ ছড়াচ্ছেন। তবে চামড়া সিন্ডিকেটের কারণে মাদরাসাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে এটা ঠিক। কওমী মাদরাসা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার কুদরতি সহযোগিতায় পরিচালিত হবে ঠিকই। দুনিয়ার কোনো বাধাই কুরআনের শিক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না। যারা সিন্ডিকেট করে গরিব দুঃখীদের অধিকার হরণ করছে তাদের বিচার আল্লাহর দরবারে হবে। তবে কওমী মাদরাসা গুলোর পরিচালকদের এ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। এবার চামড়া নিয়ে ট্যানারি মালিকরা যা করলো তা অবশ্যই শিক্ষার বিষয়। যেমন বাংলাদেশে গরু প্রবেশ বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশের সাময়িক সমস্যা হলেও এখন সেটা আশির্বাদ হয়েছে; তেমনি কোরবানির চামড়া নিয়ে ট্যানারি মালিকদের সি-িকেট করায় কওমী মাদরাসাগুলোর পরিচালকদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। মাদরাসাগুলো আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য নিজেরাই চামড়া সংরক্ষণ করতে পারে। প্রয়োজনে দু’তিনশ কওমী মাদরাসার কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে ট্যানারি শিল্প স্থাপন করা যেতে পারে। সরকারের নির্দেশে প্রতিবছর কোরবানির ঈদের আগে চামড়া ক্রয়ের জন্য ট্যানারী মালিকদের শত শত কোটি টাকা ঋণ দেয়। কওমী মাদরাসাগুলো যদি লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্রদের পশুর চামড়ায় লবন দেয়া, সংরক্ষণসহ যাবতীয় প্রশিক্ষণ দেন এবং নিজেরাই মাদরাসা পরিচালনার পাশাপাশি ট্যানারি শিল্প গড়ে তোলেন তাহলে সি-িকেট তাদের আর সমস্যার ফেলতে পারবে না। ভারতীয় গরু বাংলাদেশে প্রবেশ কমে যাওয়ায় যেমন সারাদেশের কৃষকরা গরুর খামার গড়ে তুলছেন। কৃষকরা বাসাবাড়িতে দু’চারটি করে গরু প্রতিপালন এবং এবার ঈদে বিক্রি করে কোরবানির পশুর চাহিদা মিটিয়েছেন। তেমনি কওমী মাদরাসাগুলো যদি ট্যানারি শিল্প গড়ে তোলে তাহলে লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থেকে পড়–য়া শিশু-কিশোরদের আর্থিক সমস্যায় পড়তে হবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন