শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

স্পেনের মুসলিম ইতিহাস থেকে

প্রকাশের সময় : ১৯ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. মুহাম্মদ সিদ্দিক

॥ শেষ কিস্তি ॥
কোপারনিকাস আলবাত্তানী (আলবাটেগনিয়াস) নামে আর এক মুসলিম জ্যোতিবিজ্ঞানীসহ আরজ্যাকেল অর্থাৎ আল-জারকালিকে উল্লেখ করেন তার প্রখ্যাত গ্রন্থে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে যে জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কীয় আলফোনসাইন টেবিলসমূহ প্রকাশ করেন দশম আল ফোনসো তা হোল আরব জ্যোতির্বিদ্যার অংশ বিশেষ। এতে যে দ্রাঘিমাসমূহ দেখানো হয়েছে তাতে টলেডোকে কেন্দ্র করে তা দেখানো হয়। এম আকবর আলী লেখেন, আল জারকালি টলেডোর প্রাসাদে একটি পানি ঘড়ি তৈরি করে ছিলেন (পৃষ্ঠা ৮৬৬)।
তিনি তারকারাজির সঙ্গে সৌরগতির সম্পর্ক নিয়ে সর্ব প্রথম প্রমাণ উপস্থাপন করেন। তার হিসাব মতে সে হিসাব হলো বছরে ১২. ০৪”, তবে প্রকৃত পক্ষে ১১.৮। খুবই সামান্য তফাৎ সেই যুগের গবেষণাতেও। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান জ্যোতির্বিদ কোপারনিকাস আল-জারকালি (আরজ্যাকেল নামে)ও আর একজন প্রখ্যাত মুসলিম জ্যোতির্বিদ আল বাত্তানীকে উদ্ধৃত করেন তার “ডি রিভোলিউসনিবাস” ইত্যাদি নামক গ্রন্থে। (হিট্টি, পৃষ্ঠা ৫৭১-৫৭২)। মুসলিম স্পেন ভেঙ্গে পড়তে থাকলেও, মুসলিম প-িতগণ তাদের ইজতিহাদ বন্ধ করেননি তখনও।
টলেডো খ্রিস্টানদের হাতে চলে গেলেও দু’শতাব্দী পর্যন্ত আরবী ভাষা সেখানে আইন ও ব্যবসার ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। টালোডোর খ্রিস্টান রাজা ষষ্ঠ আলফনসো ও তার কয়েক উত্তরাধিকারী তাদের মুদ্রায় আরবী ছাপ দিতেন। উল্লেখ্য যে আরাগনের প্রাথমিক এক রাজা প্রথম পিটার (১১০৪ খ্রিস্টাব্দ) শুধু মাত্র আরবী লিখতে পারতেন (হিট্টি, পৃষ্ঠা ৫৪৩)।
আর্নেস্ট বার্কার লেখেন, টলেডো যখন খ্রিস্টানদের হাতে পুনর্দখল হোল, টলেডো মসজিদের লাইব্রেরিও তাদের দখলে গেলে তা থেকে তারা ফায়দা হাসিল করে। (“দি লিগেসি অব ইসলাম,”, পৃষ্ঠা ৫৫)।
টলেডো থেকেও মুসলমানদের চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। টলেডোতে বসে ক্রিমোনার গেরার্ড ও মিকায়েল স্কট আরবী থেকে অনুবাদ কর্ম জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন ইউরোপে।
টলেডো শহর অনুবাদ কর্মের একটা বড় কেন্দ্র হওয়ার কারণ হল টলেডো মুসলমানদের হাত ছাড়া হয়ে গেলেও (১০৮৫ খ্রিস্টাব্দে) স্পেনের বাকি মুসলিম এলাকার এটি খুব নিকটবর্তী। গ্রানাডা থেকে মুসলমানরা উৎখাত হল ১৪৯২ সালে, আরো প্রায় চারশো বছর পরে। বাকি ইউরোপ তখনও অন্ধকারে। তাই মুসলমানদের উপর সামরিক আঘাত হানলেও খ্রিস্টান ইউরোপ মুসলমানদের উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান হাতড়াতে লাগল। মুসলিম এলাকার লাগোয়া তখনকার খ্রিস্টান টলেডো স্বাভাবিক একটা কেন্দ্রে পরিণত হোল এই গ্রন্থ সংগ্রহের অনুবাদ কর্মের। হিট্টি বলেন, ১০৮৫ খৃস্টাব্দে টলেডো খ্রিস্টানরা নিয়ে নিলেও এর মুসলিম শিক্ষা কেন্দ্রগুলো রয়ে যায়। ব্রিটেন থেকেও বিদ্যোৎসাহীরা টলেডোতে ভিড় জমালেন। তন্মধ্যে ছিলেন স্কটল্যান্ডের মিকায়েল স্কট (১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ) ও চেষ্টারের রবার্ট। ১১৪৫ সালে রবার্ট আল-খারিজমির এলজেবরার অনুবাদ করলেন। ১১৪৩ সালে তিন হারমান দি ডালমাসিয়ানের সঙ্গে মিলে কোরআনের প্রথম ল্যাটিন অনুবাদ করলেন। এমনকি মুসলমান ও ইহুদিদের ভিতর খ্রিস্টানী মতবাদ করতে ইউরোপের প্রথম প্রাচ্য বিষয়ক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হোল টলেডোতে ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে “অর্ডার অব প্রিচারস” নামক এক গোষ্ঠীর দ্বারা। টলেডোতে থাকাকালীন সময়ে মিকায়েল স্কট অনেক গ্রন্থের সঙ্গে আল-বিটরুজির জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থ “আল-হায়া”, ইবনে রুশদের ব্যাখ্যাসহ এরিস্টটলের কিতাব অনুবাদ করলেন। তবে সবচেয়ে বেশি বই অনুবাদ করেন টলেডোতে বসে ক্রিমোনার গেরার্ড। ১১৮৭তে তার মৃত্যুর পূর্বে তিনি ল্যাটিনে অনুবাদ করলেন টলেমীর “আল-ম্যাগেস্ট” যা আল-ফারগানির ভার্সন, আল-ফারাবীর এরিস্টটলের উপর সমালোচনা, ইউক্লিডের “ইলেমেন্টস”, এরিস্টটলের বিভিন্ন পুস্তিকা, গ্যালেন ও হিপোক্রেটসের বইসমূহ-সবই আরবী থেকে, তা সর্বমোট সত্তরটি।
টলেডোর ইহুদি আব্রাহাম বেন এজরা (১১৬৭ খ্রিস্টাব্দ) প্রাচ্যের এক ইহুদি মাসাল্লা (৮১৫ খ্রি.)-এর জ্যোতিষ বিষয় সংক্রান্ত পুস্তিকা অনুবাদ করেন। তিনি আলখারিজমির জ্যোতির্বিজ্ঞানের “টেবিল” সমূহের উপর ব্যাখ্যার অনুবাদ করেন। সেভিলের জন জোয়ানেস হিসপালেন সিস) নামে একজন খ্রিস্টান ধর্মে ধমান্তরিত সাবেক ইহুদী টলেডোতে এ সময়ে (১১৩৫-৫৩) আর্চবিশপ রেমডেন্ডের উৎসাহে আরবীতে লেখা গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষবিদ্যা, চিকিৎসা ও দর্শন সংক্রান্ত আল-ফারাগানী, আবু মাসার, আল কিল্ডি, বেন-গেবিরল ও আল-গজ্জালীর বইসমূহ অনুবাদ করেন। এর ভিতর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আল-ফারগাণির জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বই। জন এটি আরবী থেকে স্পেনের ক্যাসটাইল ভাষায় অনুবাদ করেন, আর এক সহযোগী তাকে আবার ল্যাটিনে অনুবাদ করেন।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত আরব জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের বইসমূহ ইউরোপে অনুবাদের মাধ্যমে প্রবেশ করল। টলেডো থেকে এসব অনুবাদ পিরেনিজ পর্বতমালা পার হয়ে ফ্রান্সের প্রভেন্স, লরেন হয়ে জার্মানি ও কেন্দ্রীয় ইউরোপ এমনকি ইংল্যান্ড পর্যন্ত চলে গেল। ফ্রান্সের মার্সেল বন্দরে ১১৪০ খ্রিস্টাব্দে আর্চবিশপ রেমন্ড টলেডোতে প্রচারিত সৌরজাগতিক ‘টেবিল’ সমূহের প্রদর্শনী করলেন।
জেবি ট্রেন্ড মন্তব্য করেন যে, দশম শতাব্দীর ভিতর সমগ্র স্পেনের জীবন যাত্রা মুসলমানদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। টলেডো খ্রিস্টানরা পুনর্দখল (১০৮৫ খ্রিস্টাব্দে) করলে টলেডোর মাধ্যমে বাকি ইউরোপে মুসলমানদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। (“দি লিগেসি অব ইসলাম”, পৃষ্ঠা ২৮-৩১)। একাদশ শতাব্দীতে কর্ডোভাতে বারবার উপজাতির মুসলমানদের গৃহযুদ্ধ হতে থাকলে, টলেডোতে মুসলিম সভ্যতা কেন্দ্রীভূত হয়। ১০৮৫ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টানরা টলেডো দখল করলেও মুসলিম সভ্যতা, শিক্ষা-সংস্কৃতি রয়ে যায় টলেডোতে। টলেডোর খ্রিস্টান রাজা ক্যাসটাইলের ষষ্ঠ আলফনসো নামে মাত্র খ্রিস্টান শাসক ছিলেন, তার দরবার সম্পূর্ণ মুসলমানী সভ্যতার ধারক-বাহক ছিল। এমনি অবস্থা আমরা সিসিলির পালার্মোতে খ্রিস্টান শাসক দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের দরবারে প্রায় দু’শ বছর পরে। মজার কথা আলফনসো নিজেকে “দুই ধর্মের স¤্রাট” বলে ঘোষণা করে ছিলেন। সমগ্র ইউরোপ থেকে এমনকি ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড থেকে ছাত্র-প-িত আসত টলেডোতে। নাম করা যায় ইংরেজ রবার্ট (রবর্টাস এনগ্লিকাস) যিনি কোরআনের প্রথম তরজমা করেন, মাইকেল স্কট, ডেনিয়েল মোরলে ও বাথের এডিলার্ড। এরিস্টটল, ইউক্লিড ও অন্যান্যদের বই এ সময়ে শুধু আরবীতে পাওয়া যেত। মূল গ্রিক ভাষার বই হয়ে যায় গায়েব, কট্টর খ্রিস্টানদের ধর্মান্ধ মনোভাবের কারণে। তবে পরবর্তী সময়ে আর এই বিদেশি প-িতগণ এ সবকে ইউরোপীয় ভাষাতে পেতে উদগ্রীব ছিলেন, আরবী থেকে অনুবাদ করে।
প্রাচ্যের সাহিত্য, গল্প ইত্যাদি টলেডোর মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। সিন্দবাদ (সিন্দেবার)-এর কাহিনী আরবী থেকে অনুদিত হোল। এমনকি মূলগ্রন্থ “হাজার ও এক রজনী”ও।
লেখক : ইতিহাস বিদ ও সাবেক কূটনীতিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন