রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের আতঙ্ক বেড়ে চলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের পরও থামছে না কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা। ছোট বিষয় নিয়েও জড়িয়ে পড়ছে সহিংসতায়। পাড়া-মহল্লায় দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো, স্কুল-কলেজের সামনে আড্ডা, মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া, তরুণীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবনসহ বিভিন্ন অপকর্ম করতে গড়ে তুলছে ‘কিশোর গ্যাং’। দিন দিন তারা হয়ে উঠছে ভয়াবহ। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব গ্রুপ গড়ে উঠছে হরদম। এক গ্রুপের দেখাদেখি জন্ম নিচ্ছে আরেক গ্রুপ। চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে হত্যাকান্ডে পর্যন্ত জড়াচ্ছে ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সী কিশোররা। অস্ত্র হিসেবে তারা ব্যবহার করছে ছুরি বা চাকু বা চাপাতির মতো ধারালো বস্তু। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র বা নারীঘটিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটছে হত্যাকান্ড। সর্বশেষ গত ১৬ মে বিকেলে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ৩১ নম্বর সড়কে সাহিনুদ্দিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় জড়িতরাও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। এদের মধ্যে গত শনিবার মো. মনির গোয়েন্দা পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে এবং এর আগে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে পল্লবীর ইষ্টার্ন হাউজিং এলাকায় মো. মানিক র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। নিহতের পরিবারের অভিযোগ, সাহিনুদ্দিনের পরিবারের ১২ একর জমির দখল নেয়ার চেষ্টা করছিলেন সাবেক এমপি আউয়াল। আর ওই কিশোর সন্ত্রাসীদের তিনি ৩০ লাখ টাকা ভাড়া করেছিলেন।
সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ বলেন, কিশোর অপরাধ বা কিশোর গ্যাং যে ভয়াবহ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখানে পুলিশ সব কিছু করতে পারবে না। এদের নিয়ন্ত্রণে পরিবার ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে। আর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোরও দায়িত্ব আছে। সকলকে তার নিজ নিজ জায়গা থেকে পদক্ষেপ গ্রহন করলেই কিশোর অপরাধ দমন করা সম্ভব হবে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দেশে কোমল মতি শিশু-কিশোরদের কিশোর গ্যাংয়ের নামে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, ছিনতাই, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজধানীতে এ ধরনের ৫০টির অধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে। র্যাব রাজধানীসহ সারাদেশে কিশোর অপরাধীদের গ্রেফতার এবং যারা এদের অপরাধে সম্পৃক্ত করছে তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অপরাধের পাশাপাশি মাদক পরিবহনেও কিশোরদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এ জন্য পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। শুধু গ্রেফতার বা আইন প্রয়োগ করে এদের নিয়ন্ত্রণ বা সংশোধন করা সম্ভব নয়।
আইন-শৃংখলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২ বছরে ৩৪ জন খুন হয়েছেন। এসব ঘটনায় চার শতাধিক কিশোরকে আসামি করা হয়েছে। সম্প্রতি কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ‘বড় ভাই’রা। ঢাকায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের খুনাখুনিতে কিশোর ও তরুণদের ব্যবহার করার ঘটনাও ঘটেছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় ৩৪টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। র্যাবের প্রতিবেদনে ঢাকায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং সক্রিয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয়। ঢাকার মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং সক্রিয়। এ দুই এলাকায় প্রায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং সক্রিয়। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা খুনাখুনি, মাদক, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে মিরপুর এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ইসলামি শিক্ষার অভাবে এখন সমাজে মূল্যবোধের অভাব দেখা দিয়েছে। ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত কোন শিক্ষার্থী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হতে পারে না। তাদেরকে আড্ডা দিতেও দেখা যায় না। সাম্প্রতিক সময়ে করোনার অজুহাতে মাদরাসা বন্ধ করে দিয়ে মাদরাসার শিক্ষার্থীদেরকেও এ পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, নানা কারণে কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। প্রথমে তুচ্ছ এবং পরে বড় অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িয়ে পড়ছে। গডফাদাররা তাদের নিয়ন্ত্রণ করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা আবারও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের প্রতিরোধ করতে আমরাও তৎপর রয়েছি। গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনাও কিশোর অপরাধের ভয়াবহতা সামনে নিয়ে আসে। এসব অপরাধের মধ্যে খুন, ধর্ষণ, মাদক চোরাচালান, মাদক সেবন অন্যতম। গত ৩১ মার্চ সন্ধ্যায় পুলিশ প্লাজার বিপরীত পাশে হাতিরঝিল এলাকায় অন্তত ১২ কিশোরকে আড্ডা দিতে দেখা যায়। তাদের কারো হাতে গাঁজার স্টিক, কেউ ইয়াবা সেবনে ব্যস্ত, একজনের হাতে ফেনসিডিল দেখা গেল। প্রকাশ্যে এমন অপরাধ হতে দেখে একজন বয়স্ক ব্যক্তি এগিয়ে গিয়ে আপত্তি জানান। কিন্তু কিশোর গ্রুপটি উল্টো তাঁকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেয়। এরপর ৩১ মার্চ রাত ১২টার দিকে কারওয়ান বাজার রেলগেটে দুজন লোককে বেদম মারছিল ১০-১২ জন কিশোর। তারা চলে যাওয়ার পর এই প্রতিবেদক হামলার শিকার দুই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, তাদের একজনের নাম জাহিদ। হেলাল নামের অন্যজন তার সহযোগী। জাহিদ নিজেকে ডেমরা পুলিশ ফাঁড়ির সদস্য পরিচয় দেন। তার পরনে ছিল টি-শার্ট ও জিন্স প্যান্ট। জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাদা পোশাকে মাদক কারবারি এই কিশোরদের অনুসরণ করে তিনি এ পর্যন্ত এসেছেন। পরে তিনি তাদের কবলে পড়েন।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বাসা থেকে ডেকে নিয়ে বানানী স্টার কাবাবের পাশের রাস্তায় ছুরি মেরে হত্যা করা হয় কিশোর মো. শাকিলকে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিন কিশোরকে আটক করে পুলিশ। গত ১২ জানুয়ারি দুপুরে রাজধানীর মুগদায় খুন হয় কিশোর মেহেদি হাসান। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে এ হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত ১৫ কিশোরের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।
একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কিশোর অপরাধীদের একটা বড় অংশ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান জীবনযাপন করে। রেললাইন ও বস্তি এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তারা জড়িত। বিশেষ করে মাদক, ছিনতাই ও ডাকাতির সঙ্গে তারা জড়িত।
র্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ৫০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয়। এর মধ্যে উত্তরায় ২২টি ও মিরপুরে ১০টি গ্যাং সক্রিয়। এছাড়া তেজগাঁও, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, মহাখালী, বংশাল, মুগদা, চকবাজার ও শ্যামপুরে একাধিক গ্যাং সক্রিয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা খুন, ছিনতাই-চাঁদাবাজি, শ্লীলতাহানি ও ইভটিজিং এবং মাদক ব্যবসার মতো অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের নিয়ন্ত্রক বা পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় সমাজের কিছু ‘বড় ভাই’ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পর্যায়ক্রমে আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরি করে। তাদের ড্রেস কোড থাকে, আলাদা হেয়ার স্টাইল থাকে, তাদের চালচলনও ভিন্ন। তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। নানাভাবে তারা অর্থ সংস্থানের চেষ্টা করে। এলাকার কোনো ‘বড় ভাই’র সহযোগী শক্তি হিসেবেও তারা কাজ করে।
সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, কিশোরদের একত্রিত করে কতিপয় ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত করছেন। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে। সহজ ও অল্প খরচে কিশোরদের দিয়ে তারা অপরাধ করানোর সুযোগ নিচ্ছে। অস্ত্রবাজি, মাদক ও হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা কিশোরদের ব্যবহার করে। এছাড়া কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। এটি হল কিশোর গ্যাং তৈরির একটি দিক। অন্য আরেকটি দিক হল-আমাদের দেশে শিশুদের লালনপালন করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিষয়ে যথাযথভাবে দায়িত্বপালন করছে না। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অপরাধে জড়ায় এমন একটি কথা সমাজে প্রচলিত আছে। এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও অপরাধে জড়াচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন