তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের : শত চেষ্টা, নানা প্রণোদনার পরও বৈচিত্র্য আসছে না রফতানি খাতে। ঘুরে-ফিরে কয়েকটি প্রথাগত পণ্যেই আটকে আছে রফতানি আয়। এতে চরম ঝুঁকিতে আছে খাতটি।
রফতানি আয়ের ৮৩ ভাগ নির্ভর করছে তৈরি পোশাক খাতের ওপর। এর বাইরে বেশি রফতানি হচ্ছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য এবং পাট ও পাটজাত পণ্য। এই চারটি খাতের বাইরে রফতানি নেই বললেই চলে। রফতানি খাতের বহুমুখিতার জন্য সরকার অনেকগুলো খাতে ব্যাপকহারে প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে। এরপরও এসব খাতে বিনিয়োগে উদ্যোক্তারা সাহস নিয়ে এগিয়ে আসছেন না।
রফতানি নীতিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া খাতগুলো হলোÑকৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, জুতা ও চামড়াজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিকেলস্ পণ্য, সফ্টওয়্যার ও আইসিটি পণ্য, হোম টেক্সটাইল, সমুগ্রগামী জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ফার্নিচার, টেরি টাওয়েল ও পর্যটন শিল্প। বন্ড ব্যবস্থা, ডিউটি-ড্র-ব্যাক, নগদ প্রণোদনাসহ নানা সুবিধা সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হলেও সাড়া মিলছে না এসব খাতে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির বলেন, আমাদের একটা সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে যে ব্যবসা বেশি চলে, সেদিকেই সবাই ঝোঁকেন। নতুন কিছুতে আমরা যেতে চাই না। ঝুঁকি নিতে চাই না।
‘সরকার সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ব্যবসায়ীদের নতুন উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে,’ বলেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ আশানুরূপ না হওয়ায় এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে পণ্যের বহুমুখীকরণ হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সরকারি সহায়তা পাওয়া গেলে এ খাতে আয়ের পরিমাণ বাড়বে। এজন্য রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আরও বেশি এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
গত দুই দশক ধরে দেশের রফতানি খাত পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে আছে তৈরি পোশাকের ওপর, যে কারণে তৈরি পোশাক খাতের রফতানি কমলে কমে যায় সামগ্রিক রফতানি। এই খাতের রফতানি বাড়লে বাড়ে দেশের রফতানি আয়।
যেমন আগস্টে তৈরি পোশাক রফতানি বাড়ায় মোট রফতানি আয়ে চাঙ্গাভাব দেখা গেছে। আবার আগের মাস জুলাইয়ে গার্মেন্ট পণ্য রফতানি কম হওয়ায় ধস নেমেছিল সামগ্রিক রফতানিতে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ঈদুল ফিতরের জন্য অধিকাংশ পোশাক কারখানাতেই ১০ দিনের মতো উৎপাদন বন্ধ ছিল। এতে পোশাক রফতানি হয়েছে কম, মাত্র ২১১ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক, ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। পোশাক খাতের অতিনির্ভরতার কারণে মোট পণ্য রফতানি প্রবৃদ্ধি শেষ পর্যন্ত ঋণাত্মক হয়ে যায়, ৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অবশ্য আগস্ট মাসেই পোশাক রফতানি বৃদ্ধি পায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সামগ্রিক পণ্য রফতানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রফতানি আয় হয়েছে ৫৮৩ কোটি মার্কিন ডলার। এই আয়ের ৮৩ শতাংশ বা ৪৮৪ কোটি ডলার তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে। পোশাক খাতের এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের রফতানি আয়ের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। এই প্রবৃদ্ধি মোট রফতানি আয়কে বাড়িয়ে দিয়েছে। জুলাই-আগস্টে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। এদিকে চলতি মাসেও ঈদুল আজহার ছুটিতে পোশাক কারখানা বেশ কয়েক দিন বন্ধ থাকবে। এতে পণ্য রফতানিতে চলতি মাসেই আবার গত জুলাইয়ের মতো নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
পণ্যের বহুমুখীকরণ না হলে এবং রফতানির গন্তব্য না বাড়লে অর্থনীতিতে বড় ধরনের দুর্যোগ আসতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, অর্থনীতির মূল শক্তি রফতানি হলেও বাংলাদেশ সীমিতসংখ্যক পণ্য রফতানি করছে। আর এসব পণ্যও রফতানি হচ্ছে হাতেগোনা কয়েকটি দেশে। এজন্য রফতানির পণ্যের বহুমুখীকরণ না করতে পারলে বা যেকোনো কারণে আমদানিকারক দেশগুলো আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে।
জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি পণ্যের রফতানি বাড়াতে চলতি বছর মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার ২০টি দেশে উচ্চপর্যায়ের বিশেষ প্রতিনিধি দল পাঠাবে সরকার। এ বছরেই বাণিজ্যমন্ত্রী ও সচিবের নেতৃত্বে এ মিশন শেষ হবে বলেও জানা গেছে।
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পণ্য রফতানির গন্তব্যও খুব অল্প। এজন্য পণ্য বহুমুখীকরণের পাশাপাশি ভৌগোলিক বহুমুখীকরণও প্রয়োজন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় মোট রফতানির ৮০ ভাগ হয়। এসব দেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, চিলি, চীন, ভারত, জাপান, কোরিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রফতানি বাড়ানোর চেষ্টা করছে শিল্প মালিকরা। সরকারি সহায়তায় এসব নতুন বাজার খুঁজে পাওয়া গেলেও নানা জটিলতা রয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশগুলো বেশি সুবিধা পেতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে বাজার দখল করছে।
রফতানি বহুমুখীকরণ বিষয়ে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মাফরুহা সুলতানা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের সম্ভাবনা অনেক। এ সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে ইপিবি বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমানে অপ্রচলিত পণ্য রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সেমিনার করা হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশে-বিদেশে মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। এখনই ফলাফল না পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে এগুলোর ফল পাওয়া যাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন