রফিকুল ইসলাম সেলিম : শনিবার চার ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নগরীর সিটি গেইটে আসে গ্রীন লাইন পরিবহনের বাস। সিটি গেইট থেকে দামপাড়া কাউন্টার পর্যন্ত আসতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। চালক জানান, দীর্ঘ যানজটে আটকা পড়তে হয়েছে সিটি গেইট থেকে জিইসি মোড় পর্যন্ত।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা প্রতিটি যাত্রীবাহী বাসকে এভাবে যানজটে আটকা পড়তে হচ্ছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর চারটি প্রবেশ পথের অবস্থা এখন এমনই বিশৃঙ্খল। এতে করে কর্মস্থলে ফেরা লোকজনকে নগরীতে ঢুকতে দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ এ চারটি প্রবেশ পথের প্রতিটিতেই অঘোষিতভাবে গড়ে ওঠেছে বাস টার্মিনাল। কাউন্টারের সামনে বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠানামার কারণে এসব এলাকায় তীব্র যানজট হচ্ছে। এ যানজট বিস্তৃত হচ্ছে নগরজুড়ে। এতে করে নগরী থেকে বের হওয়া এবং প্রবেশ পথে যাত্রীবাহী বাসগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহানগরী বন্দরনগরী চট্টগ্রামে নেই কোন স্থায়ী বাস টার্মিনাল। সিডিএ’র উদ্যোগে প্রথমে সলিমপুর ও পরে বালুছড়ায় এবং সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে হালিশহরে স্থায়ী বাস টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও এর কোনটিই এখনও আলোর মুখে দেখেনি। ফলে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও পয়েন্টগুলোতে অঘোষিত টার্মিনাল গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন রুটে শত শত বাস আসা-যাওয়া করছে মহানগরীতে। সড়কে বাস দাঁড় করিয়ে চলছে যাত্রী উঠানামা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে মহানগরীর প্রধান প্রবেশপথ সিটি গেইট এলাকায় যানজট বিশৃঙ্খলা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। সিটি গেইটের কিছুদূরে কর্ণেলহাট থেকে শুরু করে এ কে খান গেইট হয়ে অলংকার মোড় পর্যন্ত রাস্তার দুইপাশে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী বাস টার্মিনাল। অলংকার মোড়ের অস্থায়ী বাস টার্মিনালের পাশাপাশি সড়কের দুইপাশে দূরপাল্লার বাসের অসংখ্য কাউন্টার। এসব কাউন্টারের সামনে বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠানামা করা হচ্ছে। যাত্রীবাহী বাসের পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচলকারী ব্যক্তিগত এবং আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী ভারী যানবাহনও এ সড়ক দিয়ে চলাচল করে। এর ফলে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীব্র যানজট লেগেই থাকে।
ঈদের ছুটিতে মহানগরীর অন্যান্য এলাকা প্রায় ফাঁকা হলেও ব্যতিক্রম এ এলাকা। এখানে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যানজট লেগেই আছে। বাস চালকরা বলছেন, ঈদের পর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ দেশের প্রায় সব মহাসড়ক যানজটমুক্ত। নির্ধারিত সময়ের আগেই যাত্রীবাহী বাস নগরীতে চলে আসছে। কিন্তু সিটি গেইটে এসে তীব্র যানজটে পড়তে হচ্ছে এসব বাসগুলোকে। সিটি গেইট থেকে এ কে খান মোড় পার হয়ে নগরীতে আসার পথে যানজটে পড়তে হচ্ছে যানবাহনগুলোকে। সিটি গেইটের তীব্র জটের প্রভাব পড়ছে নগরীর জাকির হোসেন রোড হয়ে জিইসি মোড় পর্যন্ত।
অন্যদিকে সিটি গেইট থেকে পোর্টকানেকটিং রোড হয়ে যেসব যানবাহন নগরীতে আসা-যাওয়া করছে সেগুলোকেও যানজটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সিটি গেইট থেকে অলংকার মোড় পর্যন্ত সৃষ্ট যানজটের প্রভাব পড়ছে পোর্টকানেকটিং রোড থেকে আগ্রাবাদ এক্সেস রোড পর্যন্ত। পোর্টকানেকটিং রোডে বন্দরমুখী ভারী যানবাহনের চাপ থাকে বেশি। তার উপর রাস্তার দুইপাশে বাস কাউন্টারের কারণে যানজট স্থায়ী রূপ নিয়েছে।
চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক হয়ে মহানগরীর অন্যতম প্রবেশপথ কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু এলাকায়। সেতুর উত্তর পাড়ে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী বাস টার্মিনাল। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, বান্দরবান ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস-মিনিবাস রাস্তায় দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠানামা করা হচ্ছে। দূরপাল্লার বাসের পাশাপাশি সেখানে রয়েছে টেক্সি-টেম্পোর অঘোষিত স্ট্যান্ড।
এর ফলে সেতুর উত্তর প্রান্তের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীব্র যানজট হচ্ছে। বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া বাস ওই এলাকা অতিক্রম করতে কখনও এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে। একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে কক্সবাজার, বান্দরবান, দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে আসা যাত্রীবাহী বাসগুলোকে। কর্ণফুলী সেতু এলাকার ওই যানজটের প্রভাবে আশপাশের সড়কগুলোতেও তীব্র যানজট হচ্ছে। এতে করে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
একই অবস্থা মহানগরীর উত্তরপ্রান্তের প্রবেশপথ অক্সিজেন মোড়েও। সেখানে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িসহ উত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসের অস্থায়ী টার্মিনাল গড়ে উঠেছে। টার্মিনালে বাইরে রাস্তার দুইপাশে গড়ে উঠা কাউন্টারের সামনে থেকে ছেড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন রুটের বাস। এ কারণে অক্সিজেন মোড় ও আশপাশের সবকটি সড়কে যানজট এবং বিশৃঙ্খলা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। মহানগরীতে আসা-যাওয়ার পথে যাত্রীবাহী বাসগুলোকে ওই মোড়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকা পড়তে হচ্ছে ।
নগরীর অপর প্রবেশপথ কালুরঘাট সেতু এলাকার অবস্থা আরও নাজুক। প্রায় শত বছরের পুরাতন ওই রেলসেতুতেই ঝুঁকি নিয়ে একমুখী যানবাহন চলাচল করছে। এ কারণে এমনিতেই সেতু এলাকায় যানজট। তার উপর সেতুর দুইপ্রান্তের অঘোষিত বাস টার্মিনালের কারণে যানজট স্থায়ী রূপ নিয়েছে। যানবাহন চালকেরা বলছেন, নগরীর চারটি প্রবেশপথে বিশৃঙ্খল অবস্থার কারণে চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী বাসগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকা পড়তে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে পুরো মহানগরীতে।
অন্যদিকে নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারছে না যাত্রীরা। এতে সময় এবং জ্বালানীর অপচয় হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন করা হয়েছে। যানবাহন চলছে স্বাভাবিক গতিতে। কিন্তু শহরে প্রবেশ করতে গিয়ে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। শহর থেকে বের হতেও যানজটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসগুলোকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন হয়েছে কিন্তু নগরীর প্রবেশপথে যানজটের কারণে দূরপাল্লার বাস আসা-যাওয়ার পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকায় চার লেনের সুফল মিলছে না। বলা হয়েছিল শাহ আমানত সেতু চালু হলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার আসা-যাওযার সময় অন্তত এক ঘণ্টা কমে যাবে। কিন্তু সেতু এলাকায় বিশৃঙ্খলার কারণে বরং সময় এখন আরও বেশি লাগছে। এর ফলে সেতুর সুফলও পাচ্ছে না এ অঞ্চলের যাত্রীরা। এ বিশৃঙ্খল অবস্থার অবসান করতে হলে প্রবেশপথগুলো থেকে অস্থায়ী এবং অঘোষিত টার্মিনাল সরিয়ে নিতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। আর এজন্য দরকার স্থায়ী বাস টার্মিনাল।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ’র উদ্যোগে ৯০’র দশকে সলিমপুরে একটি স্থায়ী বাস টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। নতুন করে নগরীর উপকণ্ঠ হাটহাজারীর বালুছড়ায় একটি স্থায়ী বাস টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০ একর জমিতে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। অন্যদিকে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে নগরীর হালিশহরে আরও একটি স্থায়ী টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। কয়েক বছর আগে এ পরিকল্পনা নেয়া হলেও এখনও এর দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন