শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

অস্তিত্ব হারাচ্ছে খালগুলো বৃষ্টি হলেই পানিবদ্ধতা

পরিণত হয়েছে সড়ক, ড্রেন, ময়লার ভাগাড়ে : শীঘ্রই রাজধানীর বাকি ১৭টি খালও দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর

মো. জাহিদুল ইসলাম : | প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০২১, ১২:০২ এএম

ঢাকার খাল ও নদীগুলো ক্রমেই শিকার হচ্ছে ভরাট, দখল ও দূষণের। নদীগুলো পরিণত হয়েছে খালে, খালগুলো নর্দমায়। ঢাকায় প্রকৃতপক্ষে কয়টি খাল আছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কারো জরিপে ৫১টি, আবার কারো জরিপে ৪৬টি, কোথাও আবার ৩২টি। এছাড়া ঢাকার চারপাশের নদীর (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু ও ধলেশ্বরী) পানি দৃশ্যমান ময়লার ভাগাড়, কালচে পানি ও তীরবর্তী বাতাসে তীব্র দুর্গন্ধ। খালের উপরে বক্স কালভার্টের মাধ্যমে সড়ক নির্মাণের কারণে বৃষ্টি হলেই পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
খাল এখন সড়ক : ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) প্রকল্প। ১৯৬৪ সালে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরকে বন্যা থেকে রক্ষা, পানি নিষ্কাশন ও সেচ কাজের জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। চার বছর পর ১৯৬৮ সালে প্রকল্পটি শেষ হয়। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা-যাত্রাবাড়ী সড়কটি ডিএনডি বাঁধ নামে পরিচিত। এই সড়কের কাজলার পাড় খালের উপর একটি সেতু ছিল।
খালটি ব্যবহার করে নৌকা যোগে কুতুবখালী দিয়ে ধোলাইরপাড় হয়ে পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করত স্থানীয়রা। সেই খাল এখন কাজলা-কুতুবখালী সড়ক হিসেবে পরিচিত। ধোলাইখাল ও দয়াগঞ্জ খাল এখন ভরাট হয়ে ধোলাইখাল-দয়াগঞ্জ-মীরহাজীরবাগ সড়কে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টি হলেই এসব সড়কে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।
স্থানীয় এক বয়স্ক বাসিন্দা বলেন, ১৯৮৬ সালেও কুতুবখালী থেকে নৌকায় সদরঘাটে যাতায়াত করা হতো। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের আমলে গুলিস্তান থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত ঢাকা রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তখনও এই এলাকায় নৌকা চলাচল করত। পুরো এলাকাটি একটি বিল ছিল। ঢাকার শহরের সব ময়লা এই এলাকায় ফেলা হতো। ময়লা ফেলে এই এলাকা উঁচু করে যাত্রাবাড়ীর কাঁচাবাজার আড়ত তৈরি করা হয়। এরপর ২০০০ সালে খালের ওপর বক্স কালভার্ট দিয়ে এই কুতুবখালী সড়ক তৈরি করা হয়। বেশি বৃষ্টি হলেই পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
কাজলা খাল বর্তমানে ময়লার ড্রেন : ডেমরা-সারুলিয়া সড়কের কাজলাপাড় মোড় থেকে উত্তরদিকে প্রবাহিত হয়েছে ধোলাইখালের এই অংশটি কাজলাখাল। কাজলাপাড় দিয়ে খালটি মুগদা খালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কাজলার অংশে এই খালটির নাম কাজলা খাল হিসেবে পরিচিত। দেড় থেকে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ খালটির দুই পাড় ভরাট করে তৈরি হয়েছে সড়ক, দোকানপাট ও ঘরবাড়ি। এসব স্থাপনার বেশিরভাগই খালের জায়গা ভরাট করে অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলে খালটি নর্দমায় পরিণত করা হয়েছে। খালটিতে ময়লাযুক্ত কালো রঙের পানি প্রবাহ থাকলেও মাঝে মধ্যে পাইপ দিয়ে কালভার্ট তৈরির কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই অতি বৃষ্টিপাত হলে সড়ক ও বাসাবাড়িতে ময়লা পানি প্রবেশ করে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।
স্থানীয়রা আরও জানান, পুরান ঢাকার অন্যতম বিনোদন ছিল ধোলাইখালে নৌকাবাইচ কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে এটা এখন রূপকথার গল্প মনে হচ্ছে। বক্স কালভার্টের কারণে খালটি এখন ধোলাই-দয়াগঞ্জ সড়কে পরিণত হয়েছে। এক সময় মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে ধোলাইখালের ওপর লোহারপুল তৈরি করা হয়। খাল ভরাট করে সড়ক তৈরির কারণে এই এলাকায় পানিবদ্ধতার জন্য দুর্ভোগের শিকার হতে হয় জানান পুরান ঢাকাবাসীরা।
অস্তিত্ব নেই ১০টি খালের : বক্স কালভার্ট সড়কের কারণে ১০টি খালের এখন অস্তিত্ব নেই। শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত একটি খাল ছিল। ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে এর নাম পরীবাগ খাল। তবে সেখানে গিয়ে দেখা গেল খালের কোন চিহ্ন নেই। সেখানে এখন সোনারগাঁও সড়ক। পরীবাগ খালের মতোই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ঢাকার ১০টি খাল। এর মধ্যে পরীবাগ খাল, ধোলাইখাল, রায়েরবাজার খাল, আরামবাগ খাল, গোপীবাগ খাল, সেগুনবাগিচা খাল, গোবিন্দপুর খাল, কাঁঠাল বাগান খাল, নারিন্দা খাল, ধানমন্ডি খালের কোন অস্তিত্ব নেই।
স্থানীয়রা জানান, পান্থপথের পিচঢালা সড়কের নিচে চাপা পড়ে আছে একটি বিশাল খাল ও জলাভূমি। যেখানে ধানমন্ডি খাল দিয়ে এই এলাকার পানি নিষ্কাশিত হয়ে পান্থপথ হয়ে বেগুনবাড়ী খালে পড়ত। বর্ষায় পান্থপথ খালে সাঁতার কেটে এপার থেকে ওপার যাওয়া খুব সহজ ছিল না। আধুনিকতার নামে পান্থপথে বর্তমানে সড়ক ও বড় বড় অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবাই যায় না এখানে এক সময় নৌকা চলাচল করত বা সাঁতার কাঁটা যেত।
স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, প্রায় এক যুগ আগে শাহবাগ থেকে উৎপত্তি হয়ে বড় মগবাজার পর্যন্ত পরীবাগ খাল, কাঁটাসুর খাল হতে উৎপত্তি হয়ে সরাই জাফরাবাদ ও সুলতানগঞ্জ মৌজার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রায়েরবাজারের বেড়িবাঁধ পর্যন্ত রায়েরবাজার খাল, বিজয়নগর পানির ট্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত আরামবাগ খাল এবং গোপীবাগ থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছন দিয়ে আরামবাগ খাল পর্যন্ত গোপীবাগ খাল ছিল। সময়ের ব্যবধানে খালগুলো সড়কে পরিণত হয়েছে। রাজাবাজার খালটি রাজাবাজার পশ্চিম পাশ থেকে হোটেল সুন্দরবন পর্যন্ত ছিল। যা এখন বক্স কালভার্ট সড়ক। এছাড়া ধানমন্ডি খাল ও নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খালে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমান মৎস্য ভবন থেকে সেগুনবাগিচা মসজিদ হয়ে বিজয়নগর, পুরানা পল্টন দিয়ে আরামবাগ, নটরডেম কলেজের পেছন দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছন দিয়ে দক্ষিণ কমলাপুর হয়ে গোপীবাগ পর্যন্ত দীর্ঘ একটি খাল ছিল। যা বর্তমানে বক্স কালভার্ট তৈরি করে রাস্তা করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।
খাল উদ্ধারের বিষয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ওয়াসার নিকট হতে খাল হস্তান্তরের পর থেকেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দুই মেয়র খালসমূহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছেন। শুধু তাই নয় যারা এ সব খাল দখল করে দুই পাশে ভবন নির্মাণসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করেছেন সেগুলো অপসারণ করা হয়েছে।
নগরীর সব খাল রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে দুই মেয়রকে নিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়া গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে থাকা খাল ও জলাশয়গুলো শীঘ্রই দুই সিটি করপোরেশনের নিকট হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ঢাকা ওয়াসার নিকট থেকে ২৬টি খাল দুই সিটি করপোরেশনের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে এবং দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দুই মেয়র ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনায়, খালসমূহ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। এর বাহিরেও রাজধানীতে ১৭টি খাল (গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে) রয়েছে। এই খাল ও জলাশয় সমূহ ঢাকা উত্তর সিটি উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন