সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : পানি নেই। নাব্য সঙ্কটে ধুঁকছে দেশের সকল নদ-নদী। গঙ্গা চুক্তি মোতাবেক পানির ন্যায্য হিস্যা থেকেও বঞ্চিত বাংলাদেশ। সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা থাকলেও জানুয়ারি মাসে প্রায় ১০ হাজার কিউসেক পানি কম পেয়েছে। আর চুক্তির ইন্ডিকেটিভ শিডিউল অনুযায়ী পানি কম পেয়েছে ৭৭ হাজার ৯৩৫ কিউসেক।
পদ্মায় নৌ-পথ সচল রাখা হয়েছে খননের মাধ্যমে। পারিস্থিতির ভয়াবহতা দেখাতে বৃহস্পতিবার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায় নিয়ে যাওয়া হবে ভারত থেকে আসা কারিগরি কমিটিকে। শুক্রবার বাংলাদেশ-ভারত কারিগরি কমিটি এ নিয়ে বৈঠক করবে। বুধবার ভারতের প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় আসবে। এই দলের নেতৃত্বে থাকবেন ভারতের যৌথ নদী কমিশনের সদস্য শ্রী সি লাল। আর বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মো. মোফাজ্জল হোসেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) সদস্য মো. মোফাজ্জল হোসেন গতকাল সোমবার ইনকিলাবকে বলেন, এটি রুটিন বৈঠক। ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি অনুযায়ী উভয় দেশ কে কতটুকু পানি পাচ্ছে, তা পর্যালোচনা করতে এই সফর বিনিময় হয়। ভারতের প্রতিনিধি দল আসছে, এরপর বাংলাদেশ থেকেও একটি প্রতিনিধি দল ফারাক্কা পয়েন্ট পরিদর্শনে যাবে। এ ধরনের বৈঠকে গঙ্গা চুক্তির বাইরে অন্য কিছু আলোচনার সুযোগ নেই। এই কারিগরি কমিটি সুনির্দিষ্টভাবে গঙ্গা চুক্তির আলোকে কোন দেশ কী পরিমাণ পানি পাচ্ছে, তা দেখার জন্যই গঠিত। তবে এই কমিটির নেতৃত্বে যেহেতু দু’দেশের যৌথ নদী কমিশনের সদস্য রয়েছেন, সেহেতু অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের দিনক্ষণ ঠিক করার বিষয়াদি নিয়ে কথা হতে পারে। তিস্তা নদীর পানি প্রবাহের বিষয়টিকেও আমরা অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আনার চেষ্টা করব।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ভারতের অনীহায় প্রায় ছয় বছর যাবৎ বসছে না জেআরসির বৈঠক। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে দিল্লির আপত্তি এবং রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার অভাবই এজন্য দায়ী, যার বিরূপ প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমের এক মাস না যেতেই পদ্মা এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’-তে পরিণত হয়েছে। রবিঠাকুরের ছোট নদীতে বৈশাখ মাসে হাঁটুপানি থাকত। আর এখন দেশের প্রধান প্রধান সকল নদ-নদীজুড়েই হাঁটুপানি। অসংখ্য নদী মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। নদীতে পানি নেই। ফলে পদ্মা, যমুনা, মেঘনাসহ দেশের সকল নদ-নদীর নৌ-পথ সচল রাখা হয়েছে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে। গড়াই, ফেনী, মুহুরি, সুরমা, কুশিয়ারা ও তিস্তা নদীর অবস্থা আরও ভয়াবহ। এসব নদীনির্ভর সেচ প্রকল্পগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। পানির অভাবে তিস্তা, জিকে, মহুরি, মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পে এবার সেচযোগ্য জমির পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতির এই ভয়াবহতা নিরূপণে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় একেবারেই ব্যর্থ, যার চরম মূল্য দিচ্ছে এদেশের কৃষকরা।
জেআরসির মন্ত্রী পর্যায়ের সর্বশেষ ৩৭তম বৈঠকটি বসেছিল ২০১০ সালে মার্চে দিল্লিতে। আর ৩৮তম বৈঠকটি হওয়ার কথা ঢাকায়। এর আগে ২০১৩ সালের ১৮-১৯ জুন ঢাকায় জেআরসির ৩৮তম বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। ওই সময় ভারতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু প্রস্তুতির প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে দিল্লির পক্ষ থেকে বৈঠকটি বাতিল করা হয়। কেন এবং কী কারণে এই বৈঠক বাতিল করা হয়েছিল, তার বিশেষ কোনো কারণও বাংলাদেশকে জানানো হয়নি। তবে বাংলাদেশ ধরে নিয়েছিল ওই সময় ভারতে নির্বাচন থাকায় বৈঠকটি হয়নি। পরে ভারতে নরেন্দ্র মোদি সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী জেআরসির বৈঠক অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়ে একটি চিঠি পাঠায়।
এর জবাবে ভারতের পানিসম্পদ ও নদী উন্নয়নমন্ত্রী উমা ভারতী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, আপাতত জেআরসির বৈঠকে অংশ নেওয়া সম্ভব নয়। ওই সময় পানিসম্পদমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে উমা ভারতী জানান, বর্তমানে ভারতের সংসদে বাজেট অধিবেশন চলছে। পরে পারস্পরিক সুবিধামতো সময়ে বাংলাদেশে সফরে আসব। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ভারত সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় বলে উল্লেখ করে চিঠিতে তিনি আরও বলেন, দুই দেশের মধ্যে বহুমুখী সহযোগিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৯৭ সালের গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি তার একটি প্রমাণ।
পানিসম্পদমন্ত্রীকে এমন চিঠি দিলেও জেআরসির বৈঠকের দিনক্ষণ আজও জানাননি উমা ভারতী। ফলে জেআরসির বৈঠক না হওয়ায় দু’দেশের মধ্যে আটকে আছে ৫৪টি অভিন্ন নদীসংক্রান্ত অনেক অমীমাংসিত সিদ্ধান্ত।
দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেআরসির বৈঠকের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে অভিন্ন নদীর পানি সমস্যার সমাধানের বিষয়টি। বিশেষ করে জেআরসির বৈঠক না বসার অর্থ তিস্তা চুক্তি নিয়ে কালক্ষেপণ করা। চুক্তি না থাকার কারণে তিস্তার নাব্য সঙ্কট মারাত্মক রূপ নিয়েছে।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক হাবিবুর রহমান জানান, তিস্তায় যে হারে পানি কমে আসছে, এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে তীব্র পানি সঙ্কটে পড়বে বাংলাদেশ। তিস্তায় ভয়াবহ পানি হ্রাসের ফলে হাজার হাজার বিঘা জমিতে সেচকাজের ব্যাঘাত ঘটবে। চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যাও পাচ্ছে না বলে তিনি জানান।
জানা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড তিস্তা প্রকল্পে সেচযোগ্য জমির পরিমাণ ৮ হাজার হেক্টরে নামিয়ে এনেছে। এছাড়া নীলফামারীর তিন উপজেলার বাইরে তিস্তার সেচ ক্যানেলে পানি সরবরাহ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ তিস্তায় স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ থাকলে সেচযোগ্য জমি দাঁড়াত ৬৬ হাজার হেক্টরে। গেল বছর তিস্তায় সর্বনি¤œ পানি ছিল ২৪০ কিউসেক। এবার তিস্তায় সর্বনি¤œ পানি কত পাওয়া যাবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন স্থানীয় প্রশাসনসহ নদী অববাহিকার কৃষকরা।
এদিকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ফারাক্কায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছেÑভারত ফারাক্কার উজানে ছোট-বড় তিন শতাধিক খাল কেটে গঙ্গার পানি সরিয়ে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। এতে করে ফারাক্কা পয়েন্টে শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি আসার কথা তার চেয়েও অনেক কম আসছে। প্রতি শুষ্ক মৌসুমেই গঙ্গায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। গঙ্গা অববাহিকার উজানে শুষ্ক মৌসুমে কখনও আগাম বৃষ্টিপাত হলে কিংবা হিমালয়ের বরফ গলার মাত্রা বেশি হলে ফারাক্কায় পানির প্রবাহ যৎসামান্য বৃদ্ধি পায়। তবে এই বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ হয়ত কখনও হিসাবে শর্ত অনুযায়ী ৩৫ হাজার কিউসেক পানি বুঝে পায় ঠিকই, কিন্তু এই পানি বাংলাদেশের নদ-নদীর নাব্য ধরে রাখার জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। ফলে দেশের অধিকাংশ নদ-নদীই পানিশূন্য হয়ে পড়ছে।
জেআরসির তথ্যানুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে জানুয়ারির প্রথম দশ দিনে (১-১০ জানুয়ারি) গঙ্গা নদীর ফারাক্কা পয়েন্টে পানি জমেছিল ৭২ হাজার ৩৩৫ কিউসেক। এ থেকে বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক দিয়ে ভারত নেয় ৩৭ হাজার কিউসেক পানি। এখানে চুক্তির ইন্ডিকেটিভ শিডিউল অনুযায়ী বাংলাদেশ ৬৭ হাজার ৫২৬ কিউসেক পানি পাওয়ার কথা। ১১ থেকে ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় দশ দিনে গঙ্গা নদীর ফারাক্কা পয়েন্টে পানি ছিল ৬২ হাজার ৭৮৮ কিউসেক। এ থেকে বাংলাদেশকে দেয়া হয় ৩১ হাজার ৩৯৪ কিউসেক এবং ভারত নেয় ৩১ হাজার ৩৯৫ কিউসেক পানি। এখানে চুক্তির ইন্ডিকেটিভ শিডিউল অনুযায়ী বাংলাদেশ ৫৭ হাজার ৬৭৩ কিউসেক পানি পাওয়ার কথা। ২১ থেকে ৩১ জানুয়ারি তৃতীয় দশ দিনে গঙ্গা নদীর ফারাক্কা পয়েন্টে পানি ছিল ৬২ হাজার ২৮ কিউসেক। এ থেকে বাংলাদেশকে দেয়া হয় ৩১ হাজার ১৪ কিউসেক এবং ভারত নেয় ৩১ হাজার ১৪ কিউসেক পানি। এখানে চুক্তির ইন্ডিকেটিভ শিডিউল অনুযায়ি বাংলাদেশ ৫০ হাজার ১৫৪ কিউসেক পানি পাওয়ার কথা।
এদিকে রাজশাহী থেকে রেজাউল করিম রাজু জানান, শুকনো মৌসুমের শুরুতেই পদ্মায় আশঙ্কাজনক হারে পানি প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে পানি কম ছাড়ার কারনেই প্রবাহ কমে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। হার্ডিঞ্জ সেতু পয়েন্টে পানির প্রবাহ ৩৫ হাজার কিউসেকে নেমে এসেছে। পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সামনের দিনগুলোতে বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পানির অভাবে দেশের বড় গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প, পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পসহ পশ্চিমাঞ্চলের বহু সংখ্যক সেচভিত্তিক কৃষি প্রকল্প হুমকির মুখে পড়েছে।
নীলফামারী থেকে মোশাররফ হোসেন জানান, বর্তমানে তিস্তা নদীতে ১ হাজার কিউসেক পানি রয়েছে। পানিপ্রবাহ ক্রমেই কমছে বলে স্থানীয় পাউবো কর্তৃপক্ষ জানান। এতে করে চলতি বোরো চাষাবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা।
প্র্রমত্তা তিস্তা জানুয়ারির শুরু থেকেই ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে নদীর সামান্য কিছু এলাকায় হাঁটুপানি থাকলেও বেশিভাগ এলাকায় এখন ধু-ধু বালুচর। তিস্তার পানিস্বল্পতার কারণে প্রতিবছর প্রকল্প এলাকায় সেচযোগ্য জমির পরিমাণ কমিয়ে আনা হচ্ছে। এতে করে স্বাভাবিক সেচ কার্যক্রম চালাতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রমতে, ২০১৩ সালে ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে পানি সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও সেচ প্রদান করেছিল ২৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। ২০১৪ সালে ৩৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি কমিয়ে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। কিন্তু তিস্তার পানিপ্রবাহ ২৪০ কিউসেকে নেমে আসার কারনে মাত্র ৮ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হয়েছিল। আর চলতি বছর সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন