শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

শিশু : আইনি ও ইসলামী দৃষ্টিকোণ

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০২১, ১২:১৪ এএম

এ ধারা বন্ধ করে দেয়া হলে মানব সমাজ ও মানব সভ্যতা চূর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যাবে। মানব শিশুর সঙ্গে পিতা-মাতার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর স্নেহ-মমতা ও ভক্তি-শ্রদ্ধার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। পাশ্চাত্যে পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততির মাঝে যে সম্পর্কের চিত্র লক্ষ করা যায় তা অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে তুলনা করা যায়। সন্তান সে ছেলে বা মেয়ে যাই হোক প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পিতা-মাতা তাদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে নেয়, তাদের কোনো দায়িত্বই বহন করতে চায় না। ঘর থেকে তাদের বের করে দেয়। এমনকি তখন সন্তান যদি পিতার ঘরের কোনো কিছু ব্যবহার করে, তা হলে তাকে সে জন্য দস্তুরমত ভাড়া দিতে হয় এবং একজন ভাড়াটের মতই তাকে সেখানে থাকতে হয়। এমনকি বিবাহ শাদীর ব্যাপারেও পিতা-মাতা কোনো দায়িত্ব বহন করতে রাজি হয় না। সন্তান যাকে ইচ্ছা বিবাহ করুক এ ব্যাপারে পিতা-মাতার কোনো মাথা ব্যাথা বা দায়-দায়িত্ব নেই। কিন্তু ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় মানব শিশুর সাথে আচরণ সম্পূর্ণ মানবিক। সন্তান-সন্ততিকে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করা এবং কন্যা-শিশু হলে সৎ পাত্রে পাত্রস্থ করা পিতা-মাতার অপরিহার্য কর্তব্য। এমনকি সারা জীবন পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততি এক গভীর স্নেহ-মমতা, ভক্তিশ্রদ্ধা এবং আর্থিক প্রয়োজন পূরণে পরস্পর ওৎপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। কাজেই ইসলামের দৃষ্টিতে মানব শিশুই সভ্যতার রক্ষাকবচ।
শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামী দর্শন ঃ মানব শিশু মানবতার প্রতি আল্লাহ তাআলার বিরাট নিয়ামত বা দান। সে দানের জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা অপরিহার্য কর্তব্য। ইসলামে কৃতজ্ঞতা বা শোকর আদায় বলতে বোজায়-দানকৃত বস্তুর যথার্থ মূল্যায়ন ও ন্যায়ভিত্তিক ব্যবহার, যাতে আল্লাুহ নিয়ামতের প্রবাহ অব্যাহত রাখেন। আল্লাহর রহমত ও নি’য়ামতের অব্যাহত প্রবাহের প্রতিশ্র“তি অনুসারে ইবরাহীম আ.-এর ঘরে এক এক করে দু’জন মহামানব ইসমাঈল আ. ও ইসহাক আ. আবির্ভুত হয়েছিলেন। আল্লাহর প্রতি নিজের শিশু সন্তানের জন্য তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা ছিল- ‘‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়সে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। আমার রব অবশ্যই প্রার্থনা শোনেন।’’ ‘‘আল-কুরআন, ১৪:৩৯।’’
অপর আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে- ‘‘হে আমাদের রব! আমি আমার শিশুদের তোমারই সম্মানিত ঘরের কাছে শস্যবিহীন অনুর্বর উপত্যকায় বসবাস করতে রেখে গেলাম। প্রভু, সেখানে তারা সালাত কায়েম করবে। তুমি মানবজাতির হৃদয়কে তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট করে দিও এবং তাঁদেরকে ফলমূলের আহার্য সরবরাহ করো। অবশ্যই তারা তোমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারী থাকবে।’’ ‘‘আল-কুরআন, ১৪:৩৭।’’ মানব শিশুর জন্য ইসলামের অবদান হলো পিতা-মাতাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাদের সন্তানের শারীরিক ও মানসিক উন্নয়নের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যাতে সন্তান সমাজে-সংসারে সৎ ও আদর্শ নেতৃত্ব প্রদান করতে পারে। ইসলামই প্রথমে শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার ঘোষণা করেছে। প্রাচীন সমাজে যেখানে শিশু সন্তানকে অপাংতেয় মনে করা হতো সেখানে ইসলাম ঘোষণা করেছেন-‘‘আর্থিক অনটনের জন্য তোমরা নিজেদের সন্তানকে হত্যা করো না, আমি তোমাদেরকে যেভাবে জীবিকা দান করি তাদেরকেও অনুরূপভাবে দান করবো।’’ ‘‘আল-কুরআন, ৬:১৫১।’’
এ কথারই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় অন্য একটি আয়াতে- ‘‘অভাবের ভয়ে তোমরা তোমাদের শিশুদের হত্যা করো না, আমি তাদেরকে ও তোমাদেরকে রিয্ক দান করি। তাদেরকে হত্যা করা মহাপাপ।’’ ‘‘আল-কুরআন, ১৭:৩১।’’ এভাবে মানব শিশুর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইসলামের সর্বপ্রথম অবদান হলো বেঁচে থাকার অধিকার প্রদান। আর বেঁচে থাকার অধিকারের মধ্যে রয়েছে জীবনধারণে সহায়ক মৌলিক বিষয়াদির অধিকার যেমন স্বাস্থ্য রক্ষা, খাদ্য-পানীয় এবং বাস-উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করা। ইসলামের নির্দেশ হলো, সন্তানের ভরণ-পোষণের জন্য সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা যথাবিহিত ব্যবস্থা করা। ইসলামী নিয়মনীতি অনুসারে শিশু সন্তানের খাওয়া-দাওয়া, বাসস্থান, পোশাক-পরিচ্ছদ, চিকিৎসা, প্রতিপালন এবং শিক্ষা-দীক্ষার তত্ত¡াবধান প্রতিটি মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক (ফরয)।’’ ‘‘জাওয়াহিরুল কালাম, আল্লামা সাইয়েদ ইবন হাসান নাজাফী-এর বরাতে, উসূলুত্ তারবিয়াহ (বাংলা অনুবাদ), তা, বি., পৃ. ২৫।’’
মানব শিশুর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইসলামের অন্যতম প্রধান অবদান হলো শিশুদের সুশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ইসলাম শিশু অভিভাবকের ওপর দায়িত্ব দিয়েছে শিশুদের জাগতিক ও আত্মিক উন্নয়নের সু-ব্যবস্থা করা। এ প্রসঙ্গে যাকারিয়া আ. আল্লাহর কাছে যে দুআ করেন। তাঁর ভাষা ছিল- ‘‘হে রব! তুমি আমাকে এমন উত্তরাধিকার দান কর যে আমার এবং ইয়াকুব বংশের প্রতিনিধিত্ব করবে এবং হে প্রভূ! সে যেন তোমার সন্তুষ্টি লাভ করতে সক্ষম হয়।’’ ‘‘আল-কুরআন ১৯:৫-৬।’’ আলী রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে- ‘‘কোন পিতা তার সন্তানকে উত্তম আদব শেখানোর চাইতে আর কোন মূল্যবান পুরস্কার দিতে পারে।’’ ‘‘তিরমিযী, ইমাম, আস-সুনান, অধ্যায়: বিররু ওয়াস্ সিলাহ, অনুচ্ছেদ: মা জাআ ফি আদাবিল অলাদি, খ, ৪, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩৮।’’
সন্তানের শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ লাভে সাহায্য করার লক্ষ্যে পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে শিশুকে সুনাগরিকও সচ্চরিত্রবান রূপে গড়ে তোলা। এর মাধ্যমেই একজন মানব শিশুর সত্যিকার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ধ্যান-ধারণা ও চিন্তার প্রগতিশীলতার ক্ষেত্রে সন্তানকে সমাজের কাছে বরণীয় এবং মানব জাতির গৌরব হিসেবে উপস্থাপিত করতে পারাই হচ্ছে শিশুর আসল মর্যাদাবান। সন্তানকে তার সমসাময়িক রীতি ও সাংস্কৃতিক মানদন্ডে উঁচু পর্যায়ে উন্নীত করার প্রয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানব শিশুকে মর্যাদাবান, কর্মকুশলী, দক্ষ, সুশীল ন্যায়পরায়ণ, নিয়ম শৃঙ্খলানুবর্তী, আদর্শরূপে গড়ে তোলা। আর ইসলাম এ কাজগুলোই দায়িত্ব দিয়েছে পিতা-মাতা ও অভিভাবককে তারা সন্তানদের প্রকৃত শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে যেন গৌরবময় জীবনের অধিকারী করে তোলে। এ কাজে সামান্য গাফলতি করাকে তিরষ্কার করা হয়েছে। লুকমান আ. তাঁর সন্তানকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত হয়েছে সন্তানকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সেটাই হচ্ছে উত্তম পদ্ধতি। আয়াতসমূহে বলা হয়েছে- ‘‘স্মরণ কর, যখন লুকমান উপদেশচ্ছলে তাঁর পুত্রকে বললো, হে বৎস! আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না। অবশ্যই শিরক চরম জুলুম।’’ ‘‘আল-কুরআন, ৩১:১৩।’’
তারপর লকুমান আ. বলেন- ‘‘হে আমার পুত্র! কোন কিছু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা থেকে পাহাড়ের গর্তে অথবা আকাশে কিংবা মৃত্তিকার নিচে, আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত সূ²দর্শী, তিনি সকল বিষয়ের খবর রাখেন।’’ ‘‘আল-কুরআন, ৩১:১৬।’’

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন