বর্ষা শুরুতেই গত শনিবার পাহাড় ধস ও মাটি চাপায় মারা গেছেন নারীসহ দুইজন রোহিঙ্গা। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার বসতির কারণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার বন ধ্বংস হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য। ধ্বংস হয়েছে ৬ হাজার ১৬৩ একর বন। এ ছাড়া বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এশিয়ান হাতির আবাসস্থাল ও বিচরণ ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।
উখিয়া বালুখালী ও টেকনাফের চাকমারকুলে পাহাড়ের পাদদেশে চরম ঝুঁকির মাঝে বসবাসকারী প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গার মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও বাড়ছে দিনদিন। বাড়ছে পাহাড় ধসের মৃত্যুর শঙ্কা। প্রতি বছরই পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল বাড়ে। রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য পাহাড় কেটেই তৈরি করা হয়েছে ঘর। যার ফলে পাহাড়ি ঢল ও ভূমিধসের ঝুঁকিতে রয়েছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। উখিয়া বালুখালী ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারী অনেকেই জানান, এখানে বসবাস করছি কোথাও জায়গা না পেয়ে। বাধ্য হয়ে এখন পাহাড়ের ঢালুতে কোনরকম আছি কিন্তু বর্ষাকাল আসছে এখন থেকে বুক কাঁপছে। এখন থেকে মৃত্যুর ভয় কাজ করছে। শনিবার সকালে ও দুপুরে প্রবল বর্ষণের সময় এই পাহাড় ধসের ঘটনায় উখিয়ার বালুখালী ময়নারঘোনা ১২ নম্বার ক্যাম্পের রফিক উল্লাহ এবং টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং ইউনিয়নের চাকমারকুল ২১ নম্বার ক্যাম্পের নুর হাসিনা পাহাড় ধসে মারা যান। অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা নয়ন বিষয়টি জানান। করোনা সঙ্কটের মাঝেই এসেছে বর্ষা। কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির নিয়ে বাড়ছে শঙ্কা। ইউএনএইচসিআর বলছে, করোনার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থাা বিপর্যস্ত হওয়ায় সেখানে যথাযথ প্রস্তুতি নেয়া যায়নি আর তাই ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে।
রাহিঙ্গাদের বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মামুনুর রশিদ বলেন, অতিঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গা এলাকায় তালিকা করা হয়েছে। তাদের মাঝে কাজ করতে স্বেচ্ছাসেবকও প্রস্তুত রয়েছে। বর্ষার মৌসুম আমাদের মাথায় আছে। সব মিলিয়েই প্রস্তুতি নিচ্ছি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরকারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন ছাড়াও ইউএনএইচসিআর, আইওএম, ব্র্যাক এবং তুরস্ক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বড় আকারে কাজ করে। ইউএনএইচসিআর বলছে, ২০২০ সালের বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় কয়েক হাজার পরিবার সাময়িকভাবে বাস্তুচ্যূত হন। ক্ষতিগ্রস্ত হন হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী। ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, শরণার্থীদের জীবন রক্ষার কৌশলগুলো শেখানো হচ্ছে। তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবককে দ্রুত সহায়তা দেয়ার জন্য প্রস্তুত সরেজমিনে দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের অনেক এলাকায় পাহাড় একদম ন্যাড়া হয়ে গেছে। আছে শুধু ঘর-বাড়ি। যার ফলে পাহাড় আর গাছপালা কেটে বসবাস করায় পাহাড় ধসের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী এইসব রোহিঙ্গাদের কারণে বর্ষা মৌসুমে মারাত্মক বিপর্যয় ও পাহাড় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি এর (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, কক্সবাজারে পাহাড় ধসের মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু পাহাড় খেকো আর পাহাড়ে বন উজার করে গাছ কাটায় জড়িতদের দৌরাত্ম্য কমে না। প্রশাসন বর্ষা মৌসুম আসলে লোক দেখানো অভিযানে যায় নামেমাত্র। কিন্তু পুরো বছর আর খবর থাকেনা। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের পুনর্বাসন করাও দরকার। স্বপ্নের মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশঘেরা যে সুন্দর পাহাড় রয়েছে তাও রোহিঙ্গাদের জন্য কেটে ফেলা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে ধসে প্রাণহানির শঙ্কা বরাবরই বাড়ছে।
এদিকে, পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই ইউনিয়নের লগগেইট এবং ঢাকাইয়া কলোনির ৫শ’ পরিবার। ভারী বর্ষণ হলে যেকোন মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন স্থাানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিরা। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম আসলে অতি বর্ষণের ফলে মাটি পড়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে এই এলাকায়। গত রোববার কাপ্তাই উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচার প্রচারণা এবং জনগণকে সচেতন করা হয়েছে।
কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুনতাসির জাহানের নেতৃত্বে উপজেলা প্রশাসন এবং কাপ্তাই ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা ঝুঁকিপূর্ণ স্থাানে বসবাসকারীদের কাপ্তাই উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে আসার জন্য অনুরোধ জানান। এইসময় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান, কাপ্তাই ইউপি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আবদুল লতিফ, ইউপি সদস্য সজিবুর রহমানসহ স্থাানীয় জনপ্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুনতাসির জাহান জানান, এখন বৃষ্টির মৌসুম, ভারী বৃষ্টি হলে যেকোন সময় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটতে পারে, তাই আমরা তাদেরকে নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে কাপ্তাই উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আসার জন্য অনুরোধ জানাই। কাপ্তাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আবদুল লতিফ জানান, অতি বর্ষণের ফলে এই এলাকায় পাহাড় ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটে তাই তাদেরকে অনেক আগে থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে আসার জন্য অনুরোধ করে আসছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন