যুব সমাজের মধ্যে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে মেন্থল ও বিভিন্ন ফ্লেভারের সিগারেট। আগে শুধুমাত্র বিদেশী ব্রান্ডগুলোর মধ্যেই এ ধরনের সিগারেট সীমাবদ্ধ ছিল। তবে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় গত কয়েক বছর ধরে দেশে অনুমোদিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের সিগারেট বাজারে এনেছে। সাধারণ সিগারেট থেকে কয়েকগুণ বেশি ক্ষতিকর হলেও সরকারী নির্দেশনা ও জনসচেতনার অভাবে অবাধে বিক্রি হচ্ছে এগুলো। স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি অধূমপায়ীরাও আকৃষ্ট হচ্ছেন বিশেষ এই ধরনের সিগারেটের প্রতি।
মেন্থল ও ফ্লেভার্ড সিগারেটগুলো সাধারণ সিগারেটের মতোই। তবে হয় এতে তামাকের সাথেই মেন্থল/ফ্লেভার মেশানো থাকে, অথবা ফিল্টারের ভেতরে একটি থলিতে মেন্থল/ফ্লেভার রাখা থাকে। ধূমপানের সময় ফিল্টারে চাপ দিলে সেই মেন্থল/ফ্লেভার বেরিয়ে আসে ও ধোঁয়ার সাথে মিশে যায়। বাংলাদেশে সিগারেটের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত দুই ব্র্যান্ড বেনসন ও গোল্ডলিফ এই ধরনের সিগারেট বাজারজাত করছে। এর মধ্যে ‘বেনসন সুইচ’ হচ্ছে মেন্থল ও ‘গোল্ডলিফ সুইচ’ হচ্ছে স্ট্রবেরি ফ্লেভার্ড সিগারেট। উভয় সিগারেটেই ফিল্টারের ভেতরে উপাদানগুলো দেয়া থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব জানান, দুই বছর আগেও তিনি ধূমপান করতেন না। দুই একবার চেষ্টা করলেও অভ্যস্ত না হওয়ায় কাশির কারণে তিনি খুব একটা আগ্রহও বোধ করতেন না। তবে বন্ধুদের উৎসাহে একবার ‘বেনসন সুইচ’ টেনে দেখেন। মেন্থলের কারণে ঠান্ডা অনুভ‚ত হওয়ায় ও কাশি না আসায় তিনি পরে এই সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়েন। অর্থাৎ, অধূমপায়ীরাও সহজেই এই সিগারেট পান করতে পারেন।
মেন্থল সিগারেটে আসক্ত হওয়া কেন সহজ?
হেলথ জার্নাল দ্য সোয়াডল অনুসারে, মেন্থল/ফ্লেভার্ড সিগারেট ধোঁয়াকে ঠাণ্ডা করে ও এর কঠোরতা কমিয়ে দেয় (মাস্কিং ইফেক্ট)। যার ফলে ধূমপান আরো আনন্দদায়ক এবং নতুনদের জন্য সহজ পছন্দ করে তোলে। তদুপরি, এতে আসক্ত হওয়া আরো সহজ কারণ, এর শীতল প্রভাব কাশির প্রবণতা হ্রাস করে এবং গলার শুস্কভাব প্রশমিত করতে পারে যা সাধারণ সিগারেটের ক্ষেত্রে অনেক ধূমপায়ী অনুভব করেন।
বাংলাদেশে কতজন মেন্থল/ফ্লেভার্ড সিগারেট পান করেন সে বিষয়ে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া না গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রর (সিডিসি) মতে, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ধূমপায়ী (৫৪ শতাংশ) মেন্থল সিগারেট পছন্দ করেন। তদুপরি, যারা অল্প বয়স্ক হিসাবে ধূমপান শুরু করেন তাদের বেশিরভাগই মেন্থল সিগারেট দিয়ে শুরু করেন।
মেন্থল সিগারেট কেন বেশি ক্ষতিকারক?
দ্য সোয়াডল অনুসারে, মেন্থলের মাস্কিং এফেক্টের কারণে ধূমপায়ীরা আরো গভীরভাবে মেন্থল সিগারেট থেকে ধোঁয়া পান করে। শীতল বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা ফুসফুসে আরো বেশি সময় ধোঁয়া ধরে রাখে। এর ফলে মেন্থল ধূমপায়ীদের ফুসফুস সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা বিপজ্জনক রাসায়নিকগুলোতে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় বলে এক গবেষণায় দেখা গেছে। এ ধরনের সিগারেট পান করার ফলে বিপাক ক্রিয়ায় আরো বেশি প্রভাব পড়ে এবং শরীর থেকে নিকোটিন বের হতে আরো বেশি সময় লাগে। ফলে শরীরে নিকোটিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। উচ্চ মাত্রার নিকোটিনের উপস্থিতি রক্তচাপ এবং হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি করে এবং কিছু ক্ষেত্রে ধমনীর দেয়ালগুলো শক্ত করার ক্ষেত্রেও এটি ভূমিকা রাখতে পারে, যার কারণে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
সাধারণ ধূমপায়ীদের তুলনায় মেন্থল ধূমপায়ীদের স্বাস্থ্যের উপর এর যৌগিক নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মেন্থল সিগারেট পানকারীরা শ্বাস নিতে অসুবিধা বোধ করা বা কাশি-কফ বৃদ্ধিজনিত কারণে সাধারণ ধূমপায়ীদের তুলনায় আরো বেশি হাসপাতালে ভর্তি হন। গবেষণায় যুক্ত থাকা জর্জিয়ার আটলান্টায় অবস্থিত মোরহাউজ স্কুল অফ মেডিসিনের ডাঃ মেরিলিন ফোরম্যান জানিয়েছেন, মেন্থল সিগারেট পানকারীদের মধ্যে ফুসফুসে জটিল ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার হারও বেশি। অধিকন্তু, ছয় মিনিটের মধ্যে হেঁটে কতটা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে এমন একটি পরীক্ষায় মেন্থল ধূমপায়ীরা আরো খারাপ পারফর্ম করেছিলেন। সাধারণ ধূমপায়ীদের তুলনায় তারা খুব দ্রুত হাঁপিয়ে উঠেন। সামগ্রিকভাবে, গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে, সাধারণ সিগারেটের তুলনায় মেন্থল সিগারেট ব্যবহারের ফলে ফুসফুসের মারাত্মক ব্যাধি হওয়ার ঝুঁকি ২৯ শতাংশ বেশি।
করোনার প্রভাব
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারী ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত ৩০ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রস অ্যাডানম ঘেব্রেয়িসাস জানান, ‘দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া এবং কোভিডে মৃত্যুর ৫০ শতাংশ ঝুঁকি বাড়ে ধূমপায়ীদের। সুতরাং কোভিডে মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে ধূমপান ছেড়ে দেয়াই উত্তম।’ তিনি আরো জানান, শুধু কোভিড নয়, ধূমপান ছাড়লে ক্যানসার, হৃদরোগ এবং ফুসফুসঘটিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে। ভাইরাস যেহেতু শ্বাসনালী ও রেসপিরেটরি সিস্টেমকে সরাসরি আক্রমণ করে, তাই ধূমপায়ীদের জন্য করোনা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। আর যেহেতু মেন্থল ও ফ্লেভার্ড সিগারেট পানকারীদের ফুসফুস সাধারণ ধূমপায়ীদের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য কোভিড-১৯ আরো প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
শুধু তাই নয়। করোনা থেকে সুস্থ হওয়াদের ক্ষেত্রেও ধূমপান ছেড়ে দেয়া জরুরি। মেডিকা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের সিনিয়র চিকিৎসক অর্পণ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, করোনায় রক্ত জমাট বাঁধে শরীরে, বিশেষত ফুসফুসে। কোভিড আক্রান্তদের ফুসফুসের বিভিন্ন আর্টারিতে ব্লক তৈরি হয়। ধূমপানের ফলে এই রক্ত জমে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। তাই ধূমপায়ীরা করোনা থেকে সেরে উঠলে ধূমপান এক্কেবারে ছেড়ে দেয়া আবশ্যক। নইলে ফল প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
যেসব দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে
মেন্থল ও ফ্লেভার্ড সিগারেটের উচ্চ মাত্রার ঝুঁকির কারণে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের সকল সিগারেট ও তামাক নিষিদ্ধ করেছে। গত ২৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এক ঘোষণায় বলেছে, আগামী বছরের মধ্যে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। এর উদ্দেশ্য হলো এই দুটি পণ্য ব্যবহারের ফলে মানুষের যে পরিমাণ রোগ হয় এবং মারা যান তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা। এ খবর দিয়েছে মার্কিন বার্তা সংস্থা সিএনএন।
এফডিএর ভারপ্রাপ্ত কমিশনার ডক্টর জ্যানেট উডকক এক বিবৃতিতে বলেছেন, মেন্থলযুক্ত সিগারেট এবং সব ঘ্রাণযুক্ত সিগার নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে বহু প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে, এই প্রাণঘাতী পণ্যের কারণে যারা অন্যায্যভাবে আক্রান্ত হন তাদেরকে রক্ষা করা যাবে। এফডিএর এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে তারুণ্যের সময়কার এমন নেশা কমিয়ে আনতে সহায়ক হবে। এফডিএর সেন্টার ফর টোব্যাকো প্রোডাক্টসের পরিচালক মিশ জেলার বলেছেন, উন্নত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য এসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
এর আগে ২০২০ সালের ২০ মে থেকে যুক্তরাজ্যও মেন্থল সিগারেট, ফিল্টার এবং তামাক বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম ইভনিং স্টান্ডার্ড অনুসারে, নিষেধাজ্ঞাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের তামাকজাত পণ্য নির্দেশনা সংক্রান্ত আইনের অংশ যা ২০১৪ সালের ১৯ মে প্রবর্তিত হয়েছিল এবং ২০১৬ সালের ২০ মে থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোতে প্রযোজ্য হয়েছিল।
বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলে (এফসিটি) স্বাক্ষর করা প্রথম দেশগুলোর অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৫৬তম সম্মেলনে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য এফসিটিসি কনভেনশনে বাংলাদেশ ১৬ জুন, ২০০৩ ইং তারিখে স্বাক্ষর এবং ১০ মে, ২০০৪ ইং তারিখে অনুস্বাক্ষর করেছে। ২০০৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়নের পর বর্তমান সরকার ২০১৩ সালে পুরনো আইন সংশোধন করে। এরপর ২০১৫ সালে এ সংক্রান্ত বিধিমালা পাস করা হয়। তামাকের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেই টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এফসিটিসিকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তামাকবিরোধী নানান উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে বর্তমান সরকার। তাতে ইতিবাচক ফলাফলও মিলছে। ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে দেশে তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ। নিঃসন্দেহে এটা এক বিশাল অর্জন। তবে এই সাফল্যের সঙ্গে আমরা সম্ভবত ধূমপান প্রতিরোধে খানিকটা পিছিয়ে পড়েছি। তামাকজাতপণ্য ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমলেও, বেড়েছে সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা। এর পেছনে অনেকাংশে দায়ী মেন্থল ও ফ্লেভার্ড সিগারেট। অধূমপায়ীদেরকে ধূমপানে আকৃষ্ট করার জন্য এ ধরনের সিগারেট বাংলাদেশে বাজারজাত করছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও জন প্লেয়ার অ্যান্ড সন্সের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু এ ধরনের সিগারেট যে সাধারণ সিগারেটের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতিকর, ব্যবসায়িক কারণে সে বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে।
এই চিত্র আমাদের জন্য যথেষ্ট ভীতিকর। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে আমাদের জরুরি ভিত্তিতে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলনে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। এর পাশাপাশি এফসিটিসি’র আলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায়, সকলের সুস্বাস্থ্যের স্বার্থে ও ধূমপান প্রতিরোধে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অবিলম্বে সংশোধন করে উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সকল প্রকার মেন্থল ও ফ্লেভার্ড সিগারেট উৎপাদন ও বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। তাহলে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এটি হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রযাত্রা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন