সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : গ্যাস সঙ্কট নিরসনে এলএনজি টার্মিনাল সম্ভাবনার সোনালী দিগন্ত উন্মোচন করবে। একটি ভাসমান টার্মিনাল এবং তিনটি স্থল টার্মিনাল নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর যেমন চাপ কমবে, তেমনি চাহিদার বড় একটি অংশ মিটানো সম্ভব হবে আমদানি করা গ্যাসের মাধ্যমেই। ইতোমধ্যেই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দেশের প্রথম টার্মিনাল স্থাপনে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি লিমিটেডের সাথে চুক্তি সই হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি হন্যে হয়ে ঘুরছে পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য। এই ছাড়পত্র পেলেই মার্কিন এই কোম্পানি ফিজিক্যাল অন্যান্য কাজ শুরু করবে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে সাগরবক্ষে ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণ করতে নির্দিষ্ট জাহাজ নিয়ে আসা এবং ওই জাহাজ থেকে পানির নিচ দিয়ে পাইপ লাইন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা।
এই পাইপ লাইনটির সাথে যুক্ত করা হবে আনোয়ারা থেকে মহেশখালী পর্যন্ত নির্মাণ করা পাইপ লাইনটিকে। আর সংযোগ স্থলে যুক্ত করা হবে মিটার স্টেশন। যার মাধ্যমে পরিমাপ হবে কী পরিমাণ গ্যাস ভাসমান টার্মিনাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে। সরকার ২০১৮ সালের শুরুতেই দেশের প্রথম ভাসমান টার্মিনাল থেকে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এই প্রত্যাশা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়,
সে জন্য সরকারের নির্দেশনাও রয়েছে। সরকারের এমন নির্দেশনার মূল কারণ হচ্ছে, বিদেশ থেকে তরল গ্যাস আমদানির মাধ্যমে সঙ্কট মোকাবেলা এবং দেশীয় গ্যাসের উপর চাপ কমানো।
ভাসমান টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস নেয়া হবে মহেশখালি থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত। এজন্য ৯১ কিলোমিটার পাইপ লাইন নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। যদিও দু’টি রিভারক্রুসিং নির্মাণের কাজ এখনও বাকী রয়েছে বলে সূত্রটি জানায়। এ দু’টির একটি হচ্ছে মাতামুহুরি এবং অপরটি সাংগু নদী।
এছাড়াও স্থলভিত্তিক আরও ৩টি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করবে সরকার। যার প্রতিটি থেকে ১শ’ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে। এই ৩টি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ পেতে যাচ্ছে জাপান ও ফ্রান্সের দু’টি কোম্পানি। এ সংক্রান্ত ফাইলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়া গেলেই তা ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হবে।
জানা যায়, স্থলভিত্তিক তিনটি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য জাপান, ফ্রান্স, ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ প্রায় ১২টি দেশের প্রতিষ্ঠান প্রস্তাবনা জমা দেয়। বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জাপান ও ফ্রান্সের দু’টি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করা হয়েছে। এ দু’টি দেশের প্রতিষ্ঠানের নাম প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। বিশেষ আইনের আওতায় এই কাজ দেয়া হবে বিধায় এ জন্য আন্তর্জাতিক কোন দরপত্র আহ্বানের প্রয়োজন পড়বে না।
উল্লেখ্য, প্রাকৃতিক গ্যাস সাধারণ চাপ ও তাপমাত্রায় গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে। শীতলকরণ (রেফ্রিজারেশন) প্রযুক্তির মাধ্যমে তাপমাত্রা কমিয়ে ১৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনলে তা তরলে পরিণত হয়। এই তরল প্রাকৃতিক গ্যাসই হচ্ছে এলএনজি। এলএনজি টার্মিনাল দুই ধরনের হয়ে থাকে। অন-শোর (স্থলভাগে) ও অফ-শোর (পানিতে ভাসমান)।
এলএনজি আমদানির জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দেশের প্রথম টার্মিনাল স্থাপনে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি লিমিটেডের সাথে গত ১৮ জুলাই পেট্রোবাংলা চুক্তি সই করে। আর স্থলভাগে তিনটি টার্মিনাল নির্মাণের স্থান হচ্ছে- মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও পায়রা। এই তিনটি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য আগামী মাসেই (অক্টোবর) পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিল্ড অন অপারেট এন্ড ট্রান্সফার (বিওওটি) পদ্ধতিতে এই টার্মিনাল নির্মাণ হবে।
এদিকে, ভাসমান টার্মিনালের জন্য সব গ্যাস কাতার থেকেই আমদানি করা হবে নাকি কাতার ছাড়াও ওপেন মার্কেট থেকেও গ্যাস ক্রয় করা হবে সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এছাড়াও এলএনজি’র মূল্য নির্ধারণের বিষয়টিও এখন পর্যন্ত ঠিক হয়নি। সংশ্লিষ্ট ওই সূত্র মতে, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এখনও গ্যাস আমদানি এবং গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে কাজ করছে। ওই সূত্র মতে, গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট একটা ফর্মূলা বের করা হবে। এজন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সহসাই কনসালট্যান্ট নিয়োগ করবে। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম উঠানামার সাথে ভাসমান টার্মিনাল থেকে ক্রয় করা এলএনজি’র দাম সমন্বয় করার বিষয়টি যুক্ত করা হবে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান।
অপরদিকে, মহেশখালি থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইনটি নির্মাণ করছে পাঁচটি কোম্পানি। এগুলো হলো- দীপন গ্রুপ, টেকনিক গ্রুপ, পিইএল, ম্যাকসুয়েল ও গ্যাসমিন। এ ব্যাপারে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ইশতিয়াক আহমেদ জানান, ২০১৭ এর প্রথম প্রান্তিকেই টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ করা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মূলত জাহাজে করে আমদানি করা গ্যাস এই টার্মিনালে পরিশোধন করে সরবরাহ করা হবে।
ভাসমান টার্মিনাল চুক্তি ১৫ বছর বলবৎ থাকবে। এ ধরনের একটি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার প্রায় ৭ বছর পর বাংলাদেশের প্রথম এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করেছে সরকার।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সই করা টার্মশিট অনুযায়ী, ৯ মাসের মধ্যে সমীক্ষা ও টার্মিনালের নকশা প্রণয়ন করা হবে। মূল টার্মিনাল নির্মাণে আরো ১৬ মাস লাগবে। আর ২০১৭ সালের মধ্যে টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শেষ হবে।
কাতার থেকে আমদানি করা এলএনজি এই টার্মিনালের মাধ্যমে পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে বিতরণের জন্য পেট্রোবাংলার অঙ্গ প্রতিষ্ঠান গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) মহেশখালী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রায় ৯১ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ করেছে। প্রতিদিন ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সমপরিমাণ (বছরে প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন) এলএনজি আমদানির জন্য ২০১১ সালের জানুয়ারিতে কাতার সরকারের সঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে।
বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম কমে যাওয়ায় এলএনজি রপ্তানির ব্যাপারে কাতারসহ অনেক দেশই আগ্রহী। ২০১০ সালে যখন এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট (এক হাজার ঘনফুট) গ্যাসের সমপরিমাণ এলএনজির দাম ছিল প্রায় ১৪ মার্কিন ডলার। এখন তা কমে সাত-আট ডলারে দাঁড়িয়েছে।
প্রসঙ্গত, এই এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের দরপত্রসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া এগুলেও কাজ দেয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে বিদ্যুত জ্বালানি সরবরাহ বিশেষ আইনে দরপত্রের সর্বনিম্ন দরদাতা এক্সিলারেট এনার্জি পার্টনারশিপকে কাজটি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দরপত্রে প্রতি ইউনিট এলএনজি রি-গ্যাসিফিকেশনের জন্য দশমিক ৩৬ ডলার দাম দর প্রস্তাব করা হয়। তবে বিশেষ ব্যবস্থায় এর দর বাড়িয়ে করা হয়েছে দশমিক ৪৭ ডলার।
এই টার্মিনালটির ধারণক্ষমতা হবে দুই লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার। দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সমপরিমাণ এলএনজিকে গ্যাসে রূপান্তর বা রি-গ্যাসিফিকেশনের জন্য দুই লাখ ৩৮ হাজার ডলার খরচ পড়বে। এর মধ্যে স্থায়ী ব্যয় দৈনিক ধরা হয়েছে এক লাখ ৫৯ হাজার ১৮৬ ডলার, পরিচালনা ব্যয় ৪৫ হাজার ৮১৪ ডলার এবং অন্যান্য ব্যয় ৩২ হাজার ডলার।
পেট্রোবাংলার হিসাবে বাংলাদেশে দৈনিক প্রায় ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। তবে উৎপাদনের তুলনায় দেশে গ্যাসের চাহিদা অনেক বেশি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, শিল্প ও বিদ্যুৎ উন্নয়নে আমাদের যে লক্ষ্য তাতে আরও ৩৫০ কোটি ঘনফুট নতুন গ্যাস লাগবে। এ লক্ষ্য পূরণ করতে গ্যাস অনুসন্ধান চলছে, পাশাপাশি আমদানি করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ভাসমান এই টার্মিনাল ছাড়াও ভূমিতে আরও তিনটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে এক্সিলারেট এনার্জি প্রায় ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে; যা বাংলাদেশে শেভরনের পর যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানির সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে। আশা করছি ২০১৮ সালের শুরুতেই আমরা ভাসমান টার্মিনাল থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস নিতে পারবো। এছাড়াও স্থলভাগে তিনটি টার্মিনাল নির্মাণ সংক্রান্ত ফাইলটি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে তিনি জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন