বর্ষার শুরুতেও নাব্য সঙ্কটে বন্ধ দেশের উত্তরাঞ্চল-দক্ষিণের নৌরুটের একটি পথ। পদ্মা-যমুনা নদীতে নাব্য সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের অদূরে পদ্মা নদীতে আটকে আছে উত্তরাঞ্চলগামী ৩০টির বেশি জরুরি পণ্যবোঝাই কার্গো জাহাজ।
ব্রহ্মপুত্র ও যমুনায় নাব্য সঙ্কটে গাইবান্ধার সঙ্গে কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও বগুড়ার নৌ যোগাযোগ রক্ষাকারী খেয়াঘাটগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ৫২টি খেয়াঘাট নাব্য সঙ্কটের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। নৌকা চলাচল না করায় সংশ্লিষ্ট চরাঞ্চলের বাসিন্দারা সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন। ড্রেজিংয়ে স্থানীয়দের বাধার কারণে বন্ধ হওয়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি রুট। তবে নৌ-মন্ত্রণালয় বলছে, যেকোনো মূল্যে ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখালী নৌপথ চালু রাখা হবে। তবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ হবে মিয়ারচর ও পটুয়াখালীর কারখানা চ্যানেল চালু রাখা। নদী মাতৃক বাংলাদেশের আসল সৌন্দর্য যেন ধরা দেয় বর্ষার এই সময়ে, তবে স্রোতের তোড়ে কূল ছাপিয়ে কোথাও কোথাও জনপদ ডুবলেও এই পথের নাব্য সঙ্কট এখনও দুঃচিন্তার কারণ হয় সংশ্লিষ্টদের।
মূলত নদীভাঙন, অপরিকল্পিত বাঁধ ও উত্তরাঞ্চলের বন্যায় ভেসে আসা পলিতে তৈরি হয় এই বিপত্তি। সঙ্কট সমাধানে সরেজমিন পরিদর্শনে মেঘনা পাড়ি দিয়ে ঢাকা থেকে পটুয়াখালী পর্যন্ত নৌপথ যাত্রা করছেন নৌ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তারা। এসময় নদী পথের কোথায়, কত মিটার গভীরতা তা আধুনিক যন্ত্র দিয়ে মেপে দেখেন তারা।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এবার এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজছে কর্তৃপক্ষ। সে লক্ষে সরকারি বহরে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ড্রেজার। এখন দেশে ৬ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালু আছে। আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে তা ১০ হাজার কিলোমিটার করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, নাব্য সঙ্কটের জন্য প্রকৃতির পাশাপাশি এইপথে পটুয়াখালী ঢোকার মুখে কারখানা নদীতে এলাকাবাসীর খনন কাজে বাধাও দায়ী।
জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ দৌলতদিয়া-নগরবাড়ী-বাঘাবাড়ী। এ রুট দিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন পণ্যবাহী শত শত কার্গো জাহাজ চলাচল করে থাকে। কিন্তু চলতি শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি অস্বাভাবিক কমে গিয়ে নৌপথের বিভিন্ন পয়েন্টে অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে।
পাশাপাশি চ্যানেলে পানির গভীরতা কমে যাওয়ায় পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। একেকটি জাহাজকে গন্তব্যে পৌঁছতে ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত সময় লাগছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম ও মোংলাবন্দর থেকে ছেড়ে আসা উত্তরাঞ্চলের নগরবাড়ী ও বাঘাবাড়ী বন্দরগামী বিভিন্ন সার, গম, কয়লা ও ক্লিংকারবোঝাই ৩০টির অধিক কোস্টার জাহাজ গত কয়েক দিন ধরে গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের ১ কিলোমিটার ভাটিতে পদ্মা নদীতে আটকে থাকতে হচ্ছে। আটকে থাকা কার্গো জাহাজগুলো হতে ট্রলার ও বলগেটের মাধ্যমে পণ্যদ্রব্য নামিয়ে গন্তব্যে নেয়া হচ্ছে। এভাবে কয়েক দিন পণ্য খালাসের পর জাহাজ হালকা হলে সেটি পুনরায় ছেড়ে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়ীদের বাড়তি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। পণ্যসামগ্রীও যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে বিলম্ব হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে দৌলতদিয়ায় পদ্মা নদীতে নোঙর করে আটকে ছিল। এর মধ্যে এমভি প্রিন্স অব আরহাম, এমভি তাজবীদ দীবা, এমভি রাসেল-৭, এমভি শাহনেওয়াজ, এমভি মিজাব-২, এমভি সুমাইয়া ছোঁয়া, এমভি হাসিবুর, এমভি সাবিত-৫, এমভি দেশভ্রমণ, এমভি ঝর্ণাসহ ৩০টির অধিক কোস্টার জাহাজ। শত শত শ্রমিক ওই জাহাজগুলো থেকে মালামাল নামানোর হয়েছে।
এ সময় আটকেপড়া কয়েকজন কার্গো মাস্টার বলেন, নৌ-চ্যানেলের মোল্লারচর, ব্যাটারিরচর, কানাইদিয়া, লতিফপুর, নাকালিয়া ও পেঁচাখোলা এলাকায় নাব্য সঙ্কট সবচেয়ে বেশি। প্রয়োজনীয় পানির গভীরতা না থাকায় সেখানে ১০ থেকে ১৩ ফুট ড্রাফটের মালবোঝাই কোনো জাহাজ চলাচল করতে পারছে না। এ কারণে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে ছেড়ে আসা পাবনার নগরবাড়ী ও সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী বন্দরগামী বিভিন্ন মালামাল বোঝাই কোস্টার জাহাজগুলো গত কয়েক দিন যাবত দৌলতদিয়ায় আটকে পড়ে আছে।
পণ্যের আমদানি প্রতিনিধি সুমন দাস বলেন, ভরাবর্ষায় নদীতে পানি না থাকায় বিভিন্ন বন্দর থেকে ছেড়ে আসা মালামাল বোঝাই কোস্টার জাহাজগুলো আটকে পড়ে।
আটকেপড়া জাহাজ এমভি দেশভ্রমণের মাস্টার মো. ইমরুল শেখ জানান, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরিয়া সার বোঝাই ১০ ফুট ড্রাফটের জাহাজ নিয়ে এসে তিনি এখানে কয়েকবার আটকে পড়তে হয়েছে। এ অবস্থায় নৌ-চ্যানেলে দ্রুত খনন জরুরি।
বিআইডব্লিউটিএ আরিচা অঞ্চল মানিকগঞ্জ ড্রেজিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ খান ইনকিলাবকে বলেন, এবার আগাম বন্যা না হওয়ার কারণে পদ্মায় পানির গভীরতা কমেছে। এসব পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য প্রয়োজন ১২ থেকে ১৭ ফুট পানির গভীরতা। আমরা নৌ-বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সেটি প্রচার করা হচ্ছে।
বর্তমানে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলায় পাঁচটি রৌমারীতে, চারটি ও রাজিবপুরে তিনটি খেয়াঘাট, গাইবান্ধা সদরে আটটি, ফুলছড়ির ১২টি ও সাঘাটার ছয়টি, অপরদিকে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার দুটি সারিয়াকান্দির তিনটি এবং জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার তিনটি ও দেওয়ানগঞ্জের পাঁচটি নৌ ও খেয়াঘাট প্রায় বন্ধ। এসব উপজেলার অভন্তরীণ রুটে সীমিতভাবে কিছু নৌকা চলাচল করলেও মাঝপথে গিয়ে ডুবোচরে আটকে যায়। তখন যাত্রীদের দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। এদিকে নৌ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরাঞ্চলের মানুষদের এখন হেঁটে বা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে হাট-বাজারে এবং দূর-দূরান্তরে যাতায়াত করতে হচ্ছে। ফলে নারী, শিশু ও রোগীদের সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন