চীনের টিকা বাংলাদেশে ট্রায়ালের ঘোষণার পরও সেটা দিল্লির স্বার্থে আটকে দিয়েছিল কিছু প্রভাবশালী আমলা। ভারত থেকে তারা এনেছেন সেরামের টিকা। মোদি সরকার সে টিকা বাংলাদেশে আমদানি বন্ধ করে দেয়ায় ওই আমলাদের ভারত প্রেমের পরিণতি টিকা সঙ্কটে পড়ে গেছে দেশের ১৭ কোটি মানুষ। অতপর চীনের দেয়া উপহারের টিকা দিয়েই বাংলাদেশে গতকাল গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সেই টিকার মতোই চীনের অর্থে গ্রহণ করা তিস্তা মহাপ্রকল্প পড়ে গেছে আমালাদের মারপ্যাঁচে। এখানেও রয়েছে দিল্লির স্বার্থ। ভারত চায় না চীনের অর্থে তিস্তা প্রকল্প হোক। সে জন্যই চুক্তির পরও তিস্তা প্রকল্পের ধীরগতি। অথচ তিস্তা পাড়ের কোটি মানুষ মুখিয়ে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রধানমন্ত্রী শি জিং পিংয়ের তিস্তা প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন দেখার জন্য। সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি চীনের টাকায় তিস্তা মহাপ্রকল্পের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরেছেন। কিন্তু পর্দার আড়ালে দিল্লির ইশারায় আমলারা সে প্রকল্প লালফিতায় আটকে রেখে দিয়েছেন।
জানতে চাইলে তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্প পরিচালক ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পুর) মুহাম্মদ আমিরুল হক ভূঞা ইনকিলাবকে বলেন, আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। আমার জানা মতে গত ডিসেম্বরে চীনের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। তবে অর্থায়নের বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। তিস্তার নদী খনন, নদীর দুপাড়ে তীর রক্ষাকাজ, চর খনন, দুই পাড়ে স্যটেলাইট শহর নির্মাণ এবং হাজার হাজার বাড়ি ঘর রক্ষা পাবে। পরিকল্পনা কমিশন যখন প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদন দিবে তখন আবার নতুন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিবে সরকার।
আষাঢ়ের শুরুতেই তিস্তা নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। সেই ভাঙন বন্ধ এবং উত্তরাঞ্চলের স্থায়ী আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জনে তিস্তা নদীকে নিয়ে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এই প্রকল্পে সহজ শর্তে অর্থের জোগান দেয়ার প্রস্তাব সম্বলিত চিঠি চীন সরকারকে দিয়েছে বাংলাদেশ। চীনও টাকা দেয়ার ইঙ্গীত দিয়েছে। অথচ পরিকল্পনা কমিশন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের রশি টানাটানির মধ্যে আটকে আছে বাংলাদেশের এই মহাউন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পুরো উত্তরাঞ্চল পাল্টে যাবে।
জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক এ কে এম ওয়াহেদ উদ্দিন চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীনের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। চীন এই প্রকল্পে সহজশর্তে স্বল্পসুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে আগ্রহী। তবে কি পরিমাণ ঋণের সুদ হবে সে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এটা বাস্তবায়ন হলে ঘুরবে তিস্তা নদীর আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের মানুষের ভাগ্যের চাকা।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে চীনের সঙ্গে প্রকল্পের টেন্ডার ও চুক্তি হয়েছে। গত মে মাসে তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকার সম্প্রসারণ ও পুনর্বাসনসহ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি পরিকল্পনা কমিশন। এ জন্য চুক্তি হওয়ার ৫ মাস হলেও এখনো অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। প্রতিবেশী একটি দেশের ভয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা প্রকল্পটি পাস করতে চাইছে না বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে পরিকল্পনা, ড্রইং, ডিজাইন করেছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় সবকিছু বিশ্লেষণ করেছে। তারা চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। এখন অর্থের জোগান হলে আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে তিস্তা নদীকে নিয়ে মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু হয়ে যাবে। বর্তমান সরকারের আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সকল আয়োজন চলছে। একমাস আগে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে চীন সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে অর্থের জোগান দিতে বলা হয়েছে। দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে সফলভাবে আলোচনা চলছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার যেমন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী, তেমনি চীন সরকারও অর্থ দিতে আগ্রহী। তিস্তা প্রকল্পটি দেশের জন্য একটি লাভজনক প্রকল্প হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্র্যপীড়িত জেলা লালমনিরহাটকে অর্থনৈতিকভাবে স্থায়ী সমৃদ্ধশালী করতে তিস্তা নদীকে ঘিরে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প পরিকল্পনা ও নদী পর্যবেক্ষণ কাজটি দুই বছর ধরে মাঠ পর্যায়ে করেছে চায়নার প্রতিষ্ঠান চায়না পাওয়ার ও চায়না রিভার ইয়েলো।
এদিকে তিস্তা সেচ প্রকল্পের মোট ব্যয় ১ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। এর মাধ্যমে এক লাখের বেশি হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় আসবে। ফলে বছরে অতিরিক্ত প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন বাড়বে। একইসঙ্গে অন্যান্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়বে ৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। যার বর্তমান বাজারমূল্য এক হাজার কোটি টাকা। এর পাশাপাশি ৮৬ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে চলতি সময় থেকে ২০২৪ সালের জুন মেয়াদ পযর্ন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্প এলাকা ধরা হয়েছে, নীলফামারীর সদর, সৈয়দপুর, কিশোরগঞ্জ, ডিমলা ও জলঢাকা, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা ও চিরিবন্দর এবং রংপুরের গঙ্গাচড়া, সদর, তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জে বাস্তবায়িত হবে। তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকার সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় সেচের আওতা বাড়বে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অধিকতর উন্নীতকরণ, পরিবেশ তথা জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও প্রকল্প এলাকায় বসবাসরত ৩০ লাখ জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে। প্রকল্পের আওতায় ৭৭১ কিলোমিটার খাল ও সেচ কাঠামো শক্তিশালীকরণ, ৭২ কিলোমিটার সেচ পাইপ স্থাপন, ১ হাজার ৮৫টি সেচ কাঠামো নির্মাণ ও মেরামত করা হবে।
উল্লেখ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার উত্তরাঞ্চলের মানুষকে তিস্তা নদী ঘিরে মহাপরিকল্পনা উপহার দিতে চান। আট হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হবে। বাঁধের দুই পাশে থাকবে সমুদ্র সৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ। যাতে পর্যটকরা লং ড্রাইভে যেতে পারেন। এছাড়া এই রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হবে। নদী পাড়ের দুই ধারে গড়ে তোলা হবে হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন নগরী। টাউন নামের আধুনিক পরিকল্পিত শহর, নগর ও বন্দর গড়ে তোলা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তিস্তা পাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন