ফারুক হোসাইন : দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বর্তমানে কেবল মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ায় মন্ত্রণালয় মনে করে, এ প্রক্রিয়ায় বাদ পড়তে পারেন অনেক যোগ্য প্রার্থী। এমন অবস্থায় সম্প্রতি লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের নির্দেশনা দেয়া হয়। নিয়োগের আগে পুলিশ ভেরিফিকেশনেরও তাগিদও দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা দেয়ার পরপরই বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও শিক্ষাবিদেরা। বিদ্যমান নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ উল্লেখ করে তারা বলেন, এক্ষেত্রে কোন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ নেই। এছাড়া সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দেশনা নয়, বরং পরামর্শ দিতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তারা। তবে পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষাবিদেরা।
কেবল মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ হওয়ায় অনিয়ম এড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা নিতে সম্প্রতি নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাওয়া গোপনীয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) এসব নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়। একইসাথে সরকারবিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত ‘অপরাধীদের’ নিয়োগ ঠেকাতে সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ করতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জঙ্গী তৎপরতা রুখতে পুলিশের ভেরিফিকেশন বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করলেও শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই বলে মন্তব্য করেছেন। শিক্ষাবিদেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ, যথেষ্ট এবং কার্যকরী উল্লেখ করেছেন। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন নিয়োগের বিষয়ে সরকার কোন নির্দেশনা নয়, বরং পরামর্শ দিতে পারে বলেও জানানো হয়।
দেশে বর্তমানে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, এর ৩৭টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয় দেখভালের দায়িত্ব ইউজিসি’র। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে ফলাফলের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। পাশাপাশি নিয়োগের আগে মৌখিক পরীক্ষায় বসতে হয় নিয়োগ প্রার্থীদের। তবে সম্প্রতি মন্ত্রণালয় থেকে ইউজিসি সচিবকে পাঠানো নির্দেশনায় বলা হয়ে, ইদানিং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ অনভিপ্রেত অবস্থার সমাধানকল্পে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাওয়া গোয়েন্দা বিভাগের গোপনীয় প্রতিবেদনে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার লক্ষ্যে দু’টি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে শুধু মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়, এতে অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলে প্রার্থীর মেধা যাচাই করা সহজ হবে এবং অনিয়মের সুযোগ হ্রাস পাবে।
এছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগের পূর্বে কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশন বা গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্যাদি যাচাই হয় না। ফলে সরকারবিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত ব্যক্তি বা অপরাধীরা নিয়োগের সুযোগ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের আগে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করে নিয়োগ করা যাবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এসব নির্দেশনা অনুসরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে তা মন্ত্রণালয়কে জানাতে ইউজিসিকে অনুরোধ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনার বিষয়ে শিক্ষাবিদেরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দেশনা নয়, পরামর্শ দিতে পারে সরকার। বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়োগের বর্তমান পদ্ধতিই যথেষ্ট স্বচ্ছ। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গি তৎপরতা রুখতে পুলিশ ভেরিফিকেশন রাখার পক্ষে মত তাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা নয়, পরামর্শ দিতে পারে সরকার। তাছাড়া, বর্তমানের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিই যথেষ্ট স্বচ্ছ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের কথা বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। তবে শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা অযৌক্তিক। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধার ভিত্তিতেই শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধার স্বাক্ষর রেখেই ফলাফল অর্জন করে শিক্ষক নিয়োগ প্রার্থীরা। এছাড়া নিয়োগের সময় আবেদনকৃত প্রার্থীদের মধ্য থেকে অপেক্ষাকৃত সবচেয়ে মেধাবীদেরই নিয়োগ দেয়ার বিধান রয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আব্দুল মান্নান বলেন, শিক্ষক নিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা নয়, একটি সুপারিশ দিয়েছে। কমিশনের মতে, নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটই নেবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, আমরা ইউজিসিকে বলেছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন এটা ইনডোর্স করে। যেহেতু ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখাশোনা করে, এজন্য ইউজিসিকে বলেছি। এটা সরকারের ইচ্ছা, সরকার এটা ইউজিসির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে চায়। এটা সরকারের আদেশ কি না- এ প্রশ্নে অতিরিক্ত সচিব বলেন, এটাকে আদেশ, নির্দেশনা নাকি অনুরোধ বলব, সেটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হলো এটা এখন সময়ের দাবি এবং প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়কে এটা করার জন্য অনুরোধ করেছি, তারা যেন এটা করে। তবে এটার মধ্যে ফোর্সও আছে। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এইচএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তির সুপারিশ করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তা আমলে নেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত হলেও সরকার অর্থ দেয় বলে নির্দেশনাও দিতে পারে মন্তব্য করে অতিরিক্ত সচিব হেলাল বলেন, প্র্যাকটিসটা এ রকম নাই দেখে আমরা সরাসরি বলি না যে অমুকটা করেন, তমুকটা করেন। এজন্য ইউজিসির মাধ্যমে বলি এবং খুব কম সময়েই সরাসরি কোনো কথা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা বলি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন