শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ঝুঁকিতে শত শত ভবন

কক্সবাজারে মাঝারি ভূমিকম্পেই ধসে যেতে পারে ৫০ ভাগ স্থাপনা ইকোলজিকাল ক্রিটিক্যাল এরিয়ায় উপেক্ষিত হাইকোর্ট নির্দেশনা

শামসুল হক শারেক, কক্সবাজার থেকে | প্রকাশের সময় : ৩ জুলাই, ২০২১, ১২:০০ এএম

দেশের পর্যটন রাজধানী খ্যাত কক্সবাজার শহর এবং বিস্তীর্ণ সৈকত এলাকায় গড়ে উঠা শত শত বহুতল ভবন ঝুঁকির মুখে। এসব বিল্ডিংগুলো নির্মাণের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানা হয়নি বিল্ডিং কোড। এমনকি নেই পরিবেশের ছাড়পত্র। এছাড়াও লবণাক্ত এলাকা হওয়ায় ক্ষয় হয়ে পড়েছে অধিকাংশ বিল্ডিং নিচের অংশ। সুনামি বা মাঝারি ভূমিকম্প হলেও এসব স্থাপনাগুলো মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি সিলেটে ঘন ঘন ভূমিকম্প এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মিয়ামি সৈকতে ১২ তলা বিশিষ্ট একটি আবাসিক ভবন ধসের ঘটনায় কক্সবাজার সৈকতের হোটেল মোটেল ও আবাসিক ভবনগুলো নিয়ে এই শঙ্কা দেখা দেয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে মিয়ামি সৈকতের উত্তরের সার্ফসাইড শহরের আবাসিক এলাকায় ওই ভবনটি ১৯৮০ সালে তৈরি করা হলেও মাত্র ৪০ বছর সময়ে এটি ধসে পড়ে। মাত্র ৪০ বছরের পুরোনো ভবনটিতে এমন বিপর্যয়ের কারণ এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ২০১৮ সালের এক নিরীক্ষায় সেটির নিচের দিকে পার্কিং গ্যারেজের অবকাঠামোতে গুরুতর সমস্যা ধরা পড়েছিল বলে জানা গেছে।
কক্সবাজার শহরের কলাতলীর আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে ৪ শতাধিক বহুতল হোটেল-মোটেল ভবন। একইভাবে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সৈকত এলাকায় এবং মহেশখালী, কুতুবদিয়ায় ও সেন্টমার্টিনেও তৈরি হয়েছে অসংখ্য বহুতল স্থাপনা। পরিবেশবিদদের মতে (ইকোলজিকাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া) ইসিএ এলাকায় গাদাগাদি করে গড়ে উঠা এসব স্থাপনাগুলো যেন অনেকটা কনক্রিটের পাহাড়। যেকোনো সময় ঘটতে পারে অনাকাঙ্খিত প্রাণহানির ঘটনা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে বিভিন্ন সময়ে করা জরিপ মতে ঢাকায় মোট ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়ে বেশি। রিখটার স্কেলে মাত্র ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এসব ভবনের বাসিন্দারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
কক্সবাজারে কী পরিমাণ বহুতল ভবন আছে, এগুলো বিল্ডিং কোড ও পরিবেশের ছাড়পত্র নিয়ে করা হয়েছি কি না, কোনো দফতরেই নেই এসবের সঠিক হিসাব। ২০০০ সালের পরে পর্যটন খাত চাঙ্গা হলে হু হু করে গড়ে উঠে এসব বহুতল ভবন। সন্ধান মিলছে না সৈকত এলাকায় ৩ তলা থেকে ১০ তলা পর্যন্ত এই ভবনগুলো নির্মাণের কোনো যথাযথ কর্তৃপক্ষেরও ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিছু ক্ষেত্রে কক্সবাজার পৌরসভার অনুমোদন আর কিছু ক্ষেত্রে মিলেছে জেলা প্রশাসনের অনুমোদন। তবে, এসব ক্ষেত্রেও এক ধরনের কাগজ জমা দিয়ে বিল্ডিং করা হয়েছে আরেক ধরনের। ফলে অনেকটা প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে গড়ে উঠেছে কনক্রিটের শহর! তবে, বর্তমানে কিছুটা স্বস্তির খবর হচ্ছে, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠিত হওয়ার পর বিল্ডিং-এর প্লান পাশ করাতে কিছুটা কড়াকড়ি করা হচ্ছে।
কক্সবাজার গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, গণপূর্তের তত্ত্বাবধানে নির্মিত ভবনগুলোতে বিল্ডিং কোড যথাযথবাবে অনুসরণ করা হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে তারাকা হোটেলগুলো বাদ দিলে কলাতলীর বহুতল স্থাপনাগুলোর অধিকাংশ ভবনে বিল্ডিং কোড মানা হয়েছে বলে মনে হয় না। তিনি আরো বলেন, অনুমোদন নেয়ার সময় হয়ত বিল্ডিং কোড মেনেই অনুমোদন নেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে তা অনুসরণ করা হয়নি।
এদিকে, কক্সবাজার নাজিরার টেক থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ বালুকাময় সৈকতে কোন ধরনের স্থাপনা ফিজিবল নয় বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞমহল। দেখা গেছে এই এলাকায় কোনো স্থাপনা করা হলে ভাঙন শুরু হয়। বিগত ৪-দলীয় জোট সরকারের সময় সৈকতের তিনটি পয়েন্টে জেটি স্থাপন করতে গিয়েও ভাঙনের মুখে তা সম্ভব হয়নি।
কক্সবাজার শহরতলীর নাজিরার টেক থেকে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন পর্যন্ত সৈকত এলাকাকে ইসিএ (ইকোলজিকাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া) পরিবেশ সংক্টাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়। হাইকোর্টের কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হয়নি। হাইকোর্ট সৈকত এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা এবং সেখানে নির্মিত ভবনগুলোও ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। তবে, এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব দেয়া হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য, প্রকৌশলী বদিউল আলম বলেন, কক্সবাজার শহরের ১০ ভাগেরও বেশি বিল্ডিং মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে এসব বিল্ডিং-এর ৯০ ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, সবচাইতে বড় কথা হলো এগুলো দেখার জন্য সুনির্দিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষ নেই।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো নিরূপণ করে হাইকোর্ট-এর নির্দেশনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সেইসাথে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে প্রশিক্ষণ কর্যক্রম জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন