ছোট ব্যাংকগুলো একীভূতকরণের উদ্যোগ নেয়া উচিত : ড. সালেহ উদ্দিন
সোহাগ খান : রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া নয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যক্রম শুরুর তিন বছরের মাথায় বিতরণ করা ঋণের বড় অঙ্ক খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। প্রতি প্রান্তিকেই অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এ কারণে এ সকল ব্যাংকে গ্রাহকের সঞ্চিত অর্থ নিরাপদ নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবমতে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নতুন অনুমোদন পাওয়া নয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২২৫ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯৩ কোটি টাকায়। অর্থাৎ তিন মাসেই নতুন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ, যা অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন ব্যাংকের সাবেক প্রধান নির্বাহীরা। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলো হলোÑফারমার্স, ইউনিয়ন, এনআরবি, এনআরবি কমার্শিয়াল, এনআরবি গ্লোবাল, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার, মেঘনা, মিডল্যান্ড ও মধুমতি।
নতুন ব্যাংকগুলোর ঋণ পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজি হাসান বলেন, শুরু থেকেই ব্যাংকগুলোকে ঋণ প্রদানের বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। তবে কোনো কোনো ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা না মেনে আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে জড়িয়ে পড়ে, যে কারণে স্বল্প সময়েই তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনেও ধরা পড়েছে। এখন থেকে নতুন ব্যাংকগুলোয় কঠোর নজরদারি করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণে শীর্ষে রয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের দ্য ফারমার্স ব্যাংক। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২২৩ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণ করা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৮০ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংকটির প্রধান শাখা, গুলশান, মতিঝিল, শ্যামপুরসহ বেশ কয়েকটি শাখায় প্রায় ৫৫০ কোটি টাকার অনিয়মেরও প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে কারণে ব্যাংকের মন্দঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
ব্যাংকটিতে কর্মরত একজন ঊর্ধ্বতন নির্বাহী ইনকিলাবকে বলেন, ব্যাংকিং খাতকে কলুষিত করতে যে কয়েকজন ব্যক্তি রয়েছে তাদের মধ্যে আমাদের ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক বাবুল চিশতী অন্যতম। এই ব্যাংকে কর্মরত কোনো ব্যাংকার তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী গ্রাহকদের ঋণ প্রদান করতে পারেন না। সকল গ্রাহকই চিশতী সাহেবের নিজের লোক। কোনো ব্যাংকার তার পছন্দের ব্যক্তিকে লোন না দিলে তার গায়ে হাত ওঠাতেও দ্বিধা করেন না চিশতী। মোট কথা ব্যাংকটিকে তিনি তার দোকানঘরের মতো করে রেখেছেন। তিনি ইসি কমিটির চেয়ারম্যান হলেও সকাল-সন্ধ্যা ব্যাংকে বসে থাকেন। খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, উচ্চহারে কমিশন দিয়ে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিলে তা পরিশোধে তো একটু সময় নেবেন। ফারমার্স ব্যাংকের এই দুর্গতির জন্য একজন চিশতীই এককভাবে দায়ী বলে জানান এই কর্মকর্তা। তিনি ও আরও অনেক ব্যাংকার অন্য ব্যাংকে চাকরি খুঁজছেন। কারণ তারা ভালোভাবেই বুঝে গেছেন, ফারমার্স ব্যাংকের পরিণতি ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মতো হবে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শামীমের ফোনে কল দিলে তিনি কেটে দেন।
খেলাপি ঋণের তালিকায় নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকটিতে ৪০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ থাকলেও জুন শেষে তা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৬ সালেও জুন শেষে প্রবাসীদের উদ্যোগে গঠিত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি টাকায়।
ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকই শুধু নয়, নতুন অনুমোদন পাওয়া আরো পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে এনআরবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ কোটি টাকা, যা জুন শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটি টাকায়। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি টাকায়। এছাড়া মধুমতি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১২ কোটি ৫৩ লাখ থেকে বেড়ে জুন শেষে ১৪ কোটি ৭৭ লাখ, ইউনিয়ন ব্যাংকের ১৫ লাখ থেকে ২ কোটি ৩১ লাখ ও মিডল্যান্ড ব্যাংকের ১৩ কোটি ৬৮ লাখ থেকে বেড়ে ১৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, রাজনৈতিকভাবে অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোয় কোনো কর্ম-পরিবেশ নেই। বেশিরভাগ মালিকই হঠাৎ বড়লোক হওয়া টাইপের লোক। তারা ব্যাংকিংয়ের কিছুই বোঝে না। ব্যাংকগুলোকে মুদিদোকান ভেবে অফিস করে থাকেন। সন্ধ্যাবেলায় লাভের খোঁজ করেন, যার ফলে ব্যাংকাররা আগ্রাসী ব্যাংকিং করতে বাধ্য হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির ঘাটতির ফলে জনগণের টাকা এখন অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। যে হারে নতুন ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে তাতে করে এ সকল ব্যাংকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সঞ্চয় করা কোনোক্রমেই নিরাপদ নয়। সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যতটা না উদ্বেগজনক তার চেয়ে বেশি উদ্বেগজনক রাজনৈতিক এসব ব্যাংকের খেলাপির হার। কারণ সরকারি ব্যাংক দেউলিয়া হলে তার দায়ভার সরকারের, কিন্তু এ সকল লুটেরা মালিকরা ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষিত করলে বিনিয়োগকারীরা তাদের অর্থ কোনোভাবেই ফেরত পাবেন না।
তবে রাজনৈতিকভাবে নতুন ব্যাংক দেয়ার আগে আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, পুরোনো ব্যাংকগুলোই ভালো ব্যবসা করতে পারছে না। এছাড়া দেশে দক্ষ লোকবল সংকট তো রয়েছেই। তাই নতুন ব্যাংক অনুমোদনের আগে সরকারের আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। যে হারে খেলাপি ঋণ বাড়ছে এ অবস্থায় ছোট ব্যাংকগুলো একীভূতকরণের উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন