ইনকিলাব ডেস্ক : উরির সেনা ছাউনিতে জঙ্গি হামলায় ভারতীয় সেনা নিহতের ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। ঘটনার সঙ্গে পাকিস্তান জড়িত বলে দাবি তুলেছে ভারত। তবে পাকিস্তান বলছে অন্য কথা। দেশটির দাবি, এটা মোদী সরকারের চাল। তাছাড়া কোনো ঘটনা হলেই পাকিস্তানের ওপর দায় চাপানো ভারতের স্বভাবে পরিণত হয়েছে।
উরির ঘটনায় ভারতের জনগণ উত্তেজিত। তারা চায় পাকিস্তানে হামলা করুক ভারত। দেশ থেকে পাকিস্তানি অভিনয় শিল্পীদের পিটিয়ে বের করে দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছে দেশটির কট্টরপন্থী শিবসেনারা।
এরই মধ্যে গত রোববার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার দেয়া বক্তব্যে শুধুই পাকিস্তানের সমালোচনা করায় আরও ক্ষেপে উঠেছে সে দেশের জনগণ। প্রধানমন্ত্রীর ‘মৌখিক’ হুঙ্কার এবং সেই কৌশল বিতর্কই বাড়িয়েছে শুধু। কারণ তার বক্তব্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া জবাবের হদিসই ছিল অমিল।
পরিস্থিতি সামাল দিতে গতকাল কৌশল কিছুটা পাল্টালেন মোদী। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দেশের মাটিতে রোষ সামাল দিতে মাঝামাঝি পথ নিলেন। তার বক্তব্য, যুদ্ধ না হলেও পাক জঙ্গি দমনে সামরিক অভিযান হচ্ছেই। এখন শুধু উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা। সেনাবাহিনী ঠিক করবে, কখন কোথায় এই হামলা হবে। এমন খবর দিয়েছে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার।
বিজেপির পরিষদের বৈঠকে এই ঘোষণা দেয়ার আগে গতকাল আকাশবাণীর অনুষ্ঠানেও মোদী উরি প্রসঙ্গে বলেছেন, আমাদের সেনা বেশি কথা বলে না, বীরত্বেই জবাব দেয়। তবে মোদীর বক্তব্যের সমালোচনা করেছে বিরোধীরা। তারা মনে করছে, মোদী আসলে সেনাবাহিনীর ঘাড়ে বন্দুক রেখে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন।
কংগ্রেস আগে থেকেই অভিযোগ করে আসছে মোদীর পাক-নীতি দিশাহীন। মোদীর এ দিনের ঘোষণার পরেও তারা একই অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে। কারণ, রোববারের মতো গতকালও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেননি মোদী। শুধু জঙ্গি দমনের কথা বলেছেন। উরির হামলা মোদী সরকারের ব্যর্থতা বলেও মন্তব্য করেছে কংগ্রেস।
পানি চুক্তিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে ভারত
পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানিবন্টন চুক্তি বাতিলের পথে হাঁটছে না ভারত। তবে এই চুক্তি নিয়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়ানোরই কৌশল নিয়েছে নয়াদিল্লি। এই চুক্তির আওতায় যে তিনটি নদী থেকে বেশি পানি পাকিস্তানকে সরবরাহ করা হয়, সেই তিন নদীর বৃহত্তর ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে ভারত। পশ্চিমমুখী নদীগুলির ২০ শতাংশ পানি ব্যবহার করার পরিকল্পনা নিয়েছে ভারত। এতদিন মাত্র ৮ শতাংশ পানি ব্যবহার করা হত।
সাউথ ব্লকে ১৯৬০-এর সিন্ধু চুক্তি পর্যালোচনা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেন বলে সূত্রের খবর। তিনি বলেন, রক্ত এবং পানি একসঙ্গে বইতে পারে না। সাউথ ব্লকে বৈঠকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্কর, পানিসম্পদ দফতরের সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরের পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
উরি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানকে সবক শেখাতে সিন্ধু পানিবন্টন চুক্তি বাতিলের দাবি বিভিন্ন মহলে উঠেছে। সিন্ধু পানিচুক্তি পাকিস্তানের লাইফ লাইন। এই চুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত পানির মাধ্যমে পাকিস্তানের একটা বড় অংশ সুজলা-সুফলা। ১৯৬০-এ ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খানের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। স্থির হয়, শতদ্রু, ইরাবতী, বিতস্তার পানি ভারত ব্যবহার করবে। অন্যদিকে পাকিস্তান ব্যবহার করবে ঝিলাম, সিন্ধু ও চন্দ্রভাগা নদীর পানি। পাকিস্তানের এই তিনটি নদীরই উৎসস্থল ভারত। ওদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ পানি এই নদীগুলি থেকে মেলে।
কূটনৈতিক স্তরে ইসলামাবাদের ওপর চাপ বাড়াতে এই চুক্তি বাতিল করার দাবি উঠেছে। এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করতে সিন্ধু চুক্তি পর্যালোচনার জন্য সাউথ ব্লকে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ঝিলামসহ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত তিন নদীর পানির যতটা সম্ভব বেশি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই চুক্তির বিস্তারিত ও কার্যাবলী জরুরী ভিত্তি খতিয়ে দেখতে একটি মন্ত্রী পর্যায়ের টাস্ক ফোর্সও গঠন করা হয়েছে। সরকারি সূত্রে এ কথা জানা গেছে। বৈঠকে আরও বলা হয়েছে, সিন্ধু পানি কমিশনের বৈঠক একমাত্র ‘সন্ত্রাসমুক্ত পরিবেশে’ই হতে পারে। উল্লেখ্য, এর আগে এই কমিশনের ১১২টি বৈঠক হয়েছে।
পানিবিদ্যুৎ, সেচ, পানিসঞ্চয়ের ক্ষেত্রে ওই সিন্ধু, চেনাব ও ঝিলামের পানির সর্বাধিক ব্যবহারের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি ১৯৮৭-র তুলবুল নেভিগেশন প্রকল্পের একতরফা সাসপেনশন পর্যালোচনা করে দেখা হবে বলে বৈঠকে স্থির হয়েছে।
উল্লেখ্য, জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দারা সিন্ধু চুক্তির মাধ্যমে তাদের বঞ্চনা করা হয়েছে বলে অতীতে একাধিকবার অভিযোগ করেছেন। তাদের এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই ওই তিন নদীর পানি সেচের কাজে যতটা সম্ভব বেশি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
যুদ্ধ বাধলে ধ্বংস হবে ভারতের অর্থনীতি, হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের
‘পাকিস্তানের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থেই য্দ্ধু বাধাবে না ভারত। আর পাকিস্তানকে গোটা পৃথিবীতে একঘরে করে দেওয়ার যে হুমকি ভারত দিয়েছে তাও ফাঁকা আওয়াজ মাত্র’। উরি হামলার পর ভারতের কড়া জবাবের প্রেক্ষিতে সে দেশে এমনটাই প্রচার করছেন পাক কূটনীতিবিদরা। পাকিস্তানের প্রশাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে সে দেশের আম-জনতার কাছে আবেদন রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তারপরই তড়িঘড়ি সে দেশের মানুষকে ‘বোঝানোর কাজ শুরু করেছে পাকিস্তান সরকার।
পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডিপ্লোম্যাট দাবি করেছেন যে, ভারত কখনোই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানোর ঝুঁকি নেবে না। কারণ যুদ্ধ বাধলে ভারতের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি পাকিস্তানকে বিশ্বের চোখে বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে আদতে ভারতেরই একঘরে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রোববার তার ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে দেশের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে ১৯৬৫-র যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির তুলনা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেনাবাহিনীর ওপর তার পূর্ণ আস্থা আছে বলেও জানিয়েছেন।
পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসবাদীদের মদদ দেয়া নিয়ে ভারত তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলেও অন্য সুর শোনা যাচ্ছে পাক কূটনীতিকদের গলায়। সে দেশের আরও এক ডিপ্লোম্যাটের কথায়, ‘ভারত ভুল উদাহরণ তুলে ধরছে। ভারতের মনোভাবে সবাই আঘাত পাচ্ছে। ভারত এই পথেই চলতে থাকলে পাকিস্তানের বদলে ওরা নিজেরাই একঘরে হয়ে পড়বে’।
পাকিস্তানকে জঙ্গি রাষ্ট্র ঘোষণা করতে হোয়াইট হাউজের অনলাইনে পিটিশন
পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী দেশ ঘোষণার দাবিতে মার্কিন সিনেটে পেশ করা হয়েছে পিটিশন। হাউজ সাবকমিটি অন টেররিজমের চেয়ারম্যান টেড পো এবং কংগ্রেসম্যান ডানা রোহরাব্যাকার পিটিশনটি পেশ করেন।
এ প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান টেড পো বলেন, ‘পাকিস্তান একটি বিশ্বাসঘাতক দেশ। ইসলামাবাদ বহু বছর ধরে আমেরিকার শত্রুদের হাত শক্ত করে আসছে। ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয়া থেকে শুরু করে হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এটাই প্রমাণ করে। এটাই শেষ নয়, এ ছাড়াও আরও অনেক এমন প্রমাণ রয়েছে যেটা দেখে বোঝা যায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তান কোন দিকে রয়েছে। আর যে দিকেই থাক আমেরিকার দিকে যে নেই তা বোঝা যাচ্ছে। এই বিলের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনকে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রেসিডেন্টকে ৯০ দিনের মধ্যে একটি রিপোর্ট ইস্যু করতে হবে যেখানে তাকে পরিষ্কার করে বলতে হবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সাহায্য করেছে কি না। এর ৩০ দিনের মধ্যে সেক্রেটারি অফ স্টেট একটি ফলো-আপ রিপোর্ট পেশ করবেন যেখানে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হবে অথবা কেন করা হচ্ছে না তার বিরুদ্ধে যথাযথ যুক্তি থাকতে হবে। সময় এসেছে পাকিস্তানকে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি স্বরূপ সমস্ত অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার। এবং পাকিস্তান আসলে যা, সেই সন্ত্রাসবাদী দেশ হিসাবে ঘোষণা করা’। সূত্র : আনন্দ বাজার, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও বিবিসি।
কাশ্মির দখলের স্বপ্ন অধরাই থাকবে, জাতিসঙ্ঘে সুষমা
কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। চিরকাল তাই ছিল এবং থাকবে। কাশ্মির দখল করার স্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন। উরি হামলা থেকে বিশ্বের নজর ঘোরাতে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ সভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের কাশ্মির নিয়ে মন্তব্যের এমনই জবাব দিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তিনি বলেন, ২৬/১১-এর মুম্বাই হামলা, পাঠানকোট ও উরিতে সন্ত্রাসের পেছনে একই শক্তি মদদ দিয়েছে। সারা বিশ্বে তারাই জঙ্গি কর্মকা-ের মূল সাহায্যকারী। বিশ্ববাসীর কাছে সেই শক্তির পরিচয় ফাঁস করা প্রয়োজন। সন্ত্রাস মানবাধিকারের পরিপন্থী।
তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাস কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। তার বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবরোধ গড়ে তুলতে হবে। বিভেদ ভুলে পরস্পরের হাত ধরতে হবে। কিন্তু বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেও তা বার বার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এমন রাষ্ট্রকে সরাসরি ব্রাত্য ঘোষণা করা উচিত’।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘পৃথিবীতে কিছু দেশ আছে, যারা সন্ত্রাসকে মদদ দেয়। জাতিসংঘের কাছে তেমন দেশের তালিকা রয়েছে’। এরপর সরাসরি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের নাম নিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘বালুচিস্তানে কী হচ্ছে? শান্তি নিয়ে আলোচনায় আমাদের শর্ত বলতে পাকিস্তান কী বোঝাতে চাইছে? আমরা ওঁদের যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, গত ২ বছর ধরে বন্ধুর মতো আচরণ করেছি। কিন্তু তার বদলে কী পেয়েছি? পাঠানকোট, উরি’?
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সন্ত্রাসের জীবাণু সাফ করতে আন্তর্জাতিক নীতি অবলম্বনের পক্ষে এদিন আহ্বান জানান সুষমা। যত দ্রুত সম্ভব এই বিষয়ে পদক্ষেপ জরুরী বলে তিনি জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন