অন্যান্য কৃষিজ পণ্যের মতো দেশে আমের উৎপাদনও প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষিসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের নানামুখী উদ্যোগে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে আম উৎপাদনে ৭ম স্থান অধিকার করেছে। কিন্তু রফতানির ক্ষেত্রে নানা চ্যালেঞ্জ থাকায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় আম রফতানিতে এখনো তলানিতে বাংলাদেশ। আম রফতানি বাড়ানোর লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও প্রায় ২৬টি বড় কারণে রফতানি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় আম রফতানিতে সকল সমস্যা ও চ্যালেঞ্জসমূহ দূর করে রফতানি বাড়াতে করণীয় নির্ধারণে আবারো সংশ্লিষ্টদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে।
দেশভিত্তিক আম উৎপাদনের দিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভারত। ২০১৯ সালে দেশটিতে আম উৎপাদন হয়েছে ২৫০ লাখ মেট্রিক টন। যা বিশ্ব উৎপাদনের প্রায় ৪৬ ভাগ। আম উৎপাদনে ভারতের পরেই রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, চীন, মেক্সিকো, পাকিস্তান ও মালয়। সুস্বাদু এই ফলের উৎপাদনে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সরকারি হিসেবে বাংলাদেশের উৎপাদন ছিল ১৪ লাখ মেট্রিক টন। যা বিশ্ব উৎপাদনের দুই দশমিক ছয় ভাগ। যদিও বেসরকারি হিসেবে আমের উৎপাদন প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। সপ্তম উৎপানকারী দেশ হয়েছেও বাংলাদেশ মাত্র পাঁচ লাখ মার্কিন ডলারের আম রফতানির সুযোগ পেয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে বাংলাদেশ মাত্র ৭৯১ মেট্রিক টন আম রফতানি করেছে। সরকার আম রফতানিতে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে ২৬টি কারণকে চিহ্নিত করেছে। এগুলো হচ্ছে- আম উৎপাদনে কৃষির উত্তম চর্চার অভাব, রফতানিযোগ্য উচ্চমূল্যের জাতের অপর্যাপ্ততা, নিরাপদ ও আন্তর্জাতিক গুণগত মানসম্পন্ন আমের জাত নির্বাচন ও উৎপাদনে ঘাটতি, নতুন বাজার যাচাই ও সৃষ্টিতে উদ্যোগ গ্রহণে সমন্বয়ের অভাব, প্রান্তিক বা মাইক্রো লেভেলে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও লজিস্টিক প্রাপ্তিতে সমস্যা, উৎপাদিত আমের সেলফ লাইফ কম।
সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে উৎপাদিত আমের ট্রেসিবিলিটির অভাব, সটিং এবং গ্রেডিংসহ সংগ্রহােত্তর পর্যায়ে কুলিং ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, পরিবেশ বান্ধব ও ভারসাম্যপূর্ণ মাটির উর্বরতা ব্যবস্থাপনার অভাব, কর্মী শ্রমিকের নিরাপত্তা ও অসচেতনতা, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি আমের ব্র্যান্ডিং ইমেজ সৃষ্টি না হওয়া, আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিংয়ের অভাব ইত্যাদি। এ অবস্থায়, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, কৃষি বিপণন অধিদফতর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, হর্টেক্স ফাউন্ডেশনসহ সংশ্লিস্ট বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, আম উৎপাদন ও রফতানির সঙ্গে সংশ্লিস্টদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করে চিহ্নিত সকল সমস্যা ও চ্যালেঞ্জসমূহ দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাের (বিবিএস) হিসাবে, দেশে ২ লাখ ৩৫ হাজার একর জমিতে আমবাগান রয়েছে। প্রতিটি গাছে গড়ে ৭৭ কেজি করে আম উৎপাদিত হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদিত হয়েছে ১২ লাখ ২২ হাজার টন। বাংলাদেশ হতে রফতানিকৃত আমের জাতের মধ্যে হিমসাগর, গােপালভােগ, ল্যাংড়া, হাড়িভাংগা, আম্রপালী, ফজলি, সুরমা ফজলি আম উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সউদী আরব, ওমান, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ, ইউকে, ইইউতে (ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, গ্রিস, সুইডেন) আম রফতানি হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিকে লাভজনক ও বাণিজ্যিক কৃষিতে রুপান্তর করতে বাংলাদেশের আম রফতানিতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে মানসম্পন্ন উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের যথাযথ সংরক্ষণ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে রফতানিযোগ্য আমের উৎপাদন ও রফতানির পরিমাণ ভবিষ্যতে কিভাবে সর্বোচ্চ মাত্রায় অর্জন সম্ভব হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি।
আম রফতানি সম্ভাবনা কাজে লাগানাের জন্য নতুন গন্তব্য অনুসন্ধান, রফতানি চাহিদা অনুযায়ী জাত নির্বাচন, উৎপাদন, সার ও কীটনাশক ব্যবস্থাপনা, হারভেস্টিং, পণ্য প্রস্তুতকরণ, সংরক্ষণ, প্যাকিং, সার্টিফিকেশন, পরিবহন, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন