গরু উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছেন বাংলাদেশের কৃষক ও খামারিরা। মাত্র ৬ বছরেই গবাদিপশু প্রতিপালনে দেশকে করে তুলেছে স্বাবলম্বী। শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের এই দেশ ঈদুল আজহার কোনবানির গরুর জন্য এক সময় ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ভারতের মোদি সরকার ২০১৫ সালের পহেলা এপ্রিল হঠাৎ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু প্রবেশে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করায় গরুর গোশতের সংকটে পড়ে বাংলাদেশ। কিন্তু ধীরে ধীরে দেশের কৃষকরা গ্রাম পর্যায়ে গরু প্রতিপালন, নদ-নদীর চরগুলোতে গরুর বাথান, ব্যবসায়ীরা গরুর ছোট-বড় খামার করে গরু-ছাগাল উৎপাদানে মনোনিবেশ করে। ৬ বছরের মধ্যেই গরু উৎপাদনে স্বাবলম্বী হয়ে উঠে ভারতকে উচিৎ জবাব দিয়েছেন বাংলাদেশের কৃষক আর খামারিরা। ভারতের গরু এখন আর বাংলাদেশের প্রয়োজন নেই। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ৪১ কোটি ২২ লাখ খাবার যোগ্য প্রাণী রয়েছে। ঈদুল আজহার কোরবানির জন্য পশু প্রস্তুত রাখা ১ কোটি ১৯ লাখ পশু দেশের হাটবাজারগুলোতে উঠেছে।
গতকাল রাজধানীর কয়েকটি কোরবানির পশু কেনাবেচার হাট ঘুরে দেখা গেছে শুধু গরু আর গরু। ছোট, বড়, মাঝারি নানা আকৃতির গরু সবগুলোই দেশি। কয়েক বছর আগেও কোরবানির পশুর হাটে দেখা যেত বিক্রির জন্য আনা অর্ধেকই গরুই সারা রঙের বলদ। সাদা গরুগুলোই ছিল ভারতীয়। এবার রাজধানীর গাবতলী, বনশ্রী, শনিরআখড়া, সারুলিয়াসহ কয়েকটি হাট ঘুরে দেখা গেছে বিক্রি করতে আনা ছোট-বড় সব গরুই দেশি। এমনকি দেশের কৃষকরাই বিশাল বিশাল আকৃতির গরু বিক্রির জন্য হাটে উঠিয়েছেন। তারা দামও পাচ্ছেন।
গরু প্রতিপালনের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষকরা ভারতের হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকারের কূটচালের শক্ত জবাব দিয়েছে। বাংলাদেশের মুসলমানদের আমিষের চাহিদার বড় জোগান আসে গরুর গোশত থেকে। কিন্তু এদেশের মুসলমানদের কঠিন শিক্ষা দেয়ার জন্য ২০১৫ সালে ভারতের ওই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ভারতের গরু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ নিষিদ্ধের ঘোষণা দেন। অতঃপর সীমান্তে কঠোর প্রহরা বসানো হয়। হঠাৎ করে ভারতের গরু আসা বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশে কয়েক মাস গরুর গোশতের সংকট সৃষ্টি হয়। কিন্তু দেশের কৃষকরা ব্যক্তি পর্যায়ে গরু প্রতিপালন শুরু করেন। অতঃপর চরের হাজার হাজার গরিব মানুষ গরুর বাথান শুরু করেন। গ্রামের কৃষকরা ঘরে ঘরে গরু প্রতিপালন শুরু করেন। আবার অনেক কৃষক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গরুর খামার করে গরু প্রতিপালন শুরু করেন। সারা দেশে কয়েক হাজার গরুর খামারে এখন গরু প্রতিপালন করা হচ্ছে। শুধু রাজধানী ঢাকার পাশে সাভারে ছোটবড় প্রায় এক হাজার গরুর খামার গড়ে উঠেছে। এতে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
কোরবানি পশু কেনাবেচায় শুধু গরুর হাটই নয়, প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনেও গরু কেনাবেচা চলছে। ডিজিটাল প্লাটফর্মে প্রচুর গরু কেনাবেচার হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় কোরবানির পশুর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ঢাকায় পশু আনা হতো শুধু সড়কপথ ও নৌপথের। এবার বিড়ম্বনা ছাড়াই কম খরচে গ্রামের কৃষক ও খামারিদের গরু ট্রেনে করে ঢাকায় আনা হচ্ছে। নাম দেয়া হয়েছে ‘ক্যাটল স্পেশাল’ ট্রেন।
রাজধানীর কয়েকটি হাট ঘুরে দেখা গেছে ভারতীয় গরু নেই। প্রচুর গরু সবগুলো দেশি। কিন্তু ক্রেতার সংখ্যা খুবই কম। পুরুষ ক্রেতার সাথে সাথে নারী ক্রেতাদেরও দেখা গেছে হাটে। যারা গরু বা ছাগল দেখতে আসছেন তারা শুধু দাম জিজ্ঞেস করছেন। কেনার আগ্রহ ছিল কম। এদিকে গরুর বেপারিরাও যেন বিক্রির ইচ্ছা ছিল না গতকাল। দাম জিজ্ঞেস করলে অতিরিক্ত দাম বলেছেন। এ নিয়ে ক্রেতারা বেশ বিরক্ত।
এদিকে বৃষ্টি ও গরমে হাটের পরিবেশ বেশ নাজুক। স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে মাইকে বিরতিহীন ঘোষণা করা হচ্ছিল স্বাস্থ্য সচেতনতার বিভিন্ন দিক। এসবে কাউকে কর্ণপাত করতে দেখা যায়নি। হাট ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতা-বিক্রেতার বেশিরভাগের মুখে মাস্ক নেই। হাট কর্তৃপক্ষের ভলান্টিয়ার মাস্ক দিলেও প্রায় সবাই মুখে না লাগিয়ে থুতনিতে ঝুলিয়ে রাখছে।
গতকাল হাটে দেশি জাতের ছোট আকারের গরু বিক্রি হতে দেখা গেছে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। তবে বিদেশি জাতের এবং দেশি-বিদেশি সংকর জাতের গরুর দাম আকারভেদে এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাইতে দেখা গেছে বিক্রেতাদের। বিক্রেতারা বলছেন, হাটে দেশি ছোট আকারের গরুর চাহিদা বেশি। আর গত বছরের চেয়ে এবার গরুর দামও বেশি। এ বছর হাটে ছাগলের চাহিদাও তুলনামূলকভাবে বেশি। গতকাল প্রতিটি ছাগল বিক্রি হতে দেখা গেছে ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
রাজধানীর অন্যতম গাবতলী পশুর হাটে দেখা গেছে, হাটের মূল অংশ আগেই গরু দিয়ে পূর্ণ হয়ে গেছে। এখন হাটের চারপাশে বাড়ানো হয়েছে পরিধি। বিভিন্ন জেলা থেকে গরু-মহিষ নিয়ে আসা ট্রাকগুলো জড়ো হচ্ছে বেড়িবাঁধে। সেখান থেকে গরু নামিয়ে বাঁধা হচ্ছে হাটের বর্ধিত অংশে।
হাটের ইনচার্জ সজিব সরকার জানান, প্রতি ঘণ্টায় অন্তত ১২টি ট্রাক গবাদি পশু নিয়ে আসছে দেশের বৃহত্তম এই হাটে। হাসিল ঘর ৬টা চালু হয়েছে। আজ আরো তিনটি চালু করা হবে। সজিবের জানান, হাটে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের উদ্দেশ্যে সার্বক্ষণিক মাইকিং করা হচ্ছে। হাট মালিকের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য আমরা ৪০ জন দায়িত্ব পালন করছি। এছাড়া রাইটার ও চেকার রাখা হয়েছে ৫০০ জনের বেশি।
হাটটি ঘুরে দেখা যায়, একদিকে যেমন ট্রাকে করে গরু আসছে, অন্যদিকে চলছে দামাদামি ও বিক্রি। হাটে আসা বেপারি ও খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গাবতলী হাটে ক্রেতা আনাগোনা ছিল নামমাত্র। তবে শুক্রবার সকাল থেকে বিক্রি শুরু হয়েছে। আজ থেকে পুরো দমে গরু বিক্রি হবে বলে আশাবাদী তারা। এবার গরুর দাম কিছুটা বেশি বলে জানান ব্যাপারি ও খামারিরা।
রাজশাহী থেকে ছয়টি গরু নিয়ে এসেছেন জামাল। তিনি বলেন, ‘গতকাল ভোরে হাটে আসছি। আইসাই একটা গরু বিক্রি করছি। আজ আরও দুইটা বিক্রি হইছে।’ করোনার কারণে এবাের ক্রেতারা ঝামেলা এড়াতে খুব বেশি দরদাম বা ঘোরাঘুরি করছেন না বলে দাবি জামালের। আগামী দুই দিনের মধ্যে বাকি তিনটা গরু বিক্রি করে বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন বলে আশা করছেন এই বিক্রেতা। নাটোর থেকে চারটি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাগর নিজের খামারে নিজ হাতে লালন-পালন করা গরু। খাবারের দাম বেশি, যাতায়াত খরচ বেশি। তাই দামও একটু বেশি। হাটে কাস্টমার থাকলে চিন্তা চাই।’
বসিলা হাটের বেপারি ও খামারিদের ভাষ্যমতে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিক্রি মন্দা ছিল। শুক্রবার সকাল থেকে আশার আলো দেখতে পেয়েছেন তারা। হাটে আসা অধিকাংশ দর্শনার্থীই ক্রেতা। ফলে বিক্রিও হচ্ছে আশানুরূপ। পাবনা থেকে আসা বেপারি হাসেম বলেন, ‘আইছি দুইদিন। দুই দিনে কাস্টমার দেখি নাই। কয়েকজন আইছে, দাম জিগাইছে, কেউ দাম কয় নাই। আজ সকালেই দুইটা গরু বিক্রি হইছে। বিকালে আরও কাস্টমার আসতে পারে।’
তুরাগ তীরে প্রথমবারের মতো বসা হাটটি গড়ে উঠেছে বিশাল জায়গাজুড়ে। হাট কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিতে তারা সচেষ্ট রয়েছেন। নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি ক্রেতাদের সব রকম সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করছেন তারা। বসিলা পশুর হাটের ইজারাদার আমজাদ হোসেন বলেন, আমি দুটি জীবাণুনাশক টানেল এনে রেখেছি। প্রবেশপথে জীবাণুনাশক টানেল বসানো হবে।
এছাড়া দনিয়া ও রায়েরবাগ এলাকার অস্থায়ী হাট ঘুরে দেখা যায়, সারি সারি গরু, ছাগল বেঁধে রাখা হয়েছে। সকালে বেশ কিছু গরু বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে বসা অস্থায়ী হাটটিতে হাজার হাজার গবাদি পশু বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছে। এরই মধ্যে বিক্রিও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাটের বেপারিরা।
উত্তরা-১৭ নম্বর সেক্টরে কোরবানির পশুর হাটে কোরবানির পর্যাপ্ত পশু থাকলেও গতকাল তেমন জমেনি উত্তরা-১৭ নম্বর সেক্টরের পশুর হাট। উল্লেখযোগ্য বিক্রিও হয়নি বলে জানান বিক্রেতারা। ক্রেতাও ছিল কম। গতকাল এই হাটে যেসব কোরবানির পশু বিক্রি হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগ ছিল আকারে ছোট ও মাঝারি। দিনভর ওই হাট ঘুরে অন্তত ২৫টি গরু বিক্রি হতে দেখা গেছে ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকার মধ্যে। দু-একটি বিক্রি হয়েছে এক লাখ টাকার বেশি দামে।
গরুর বেপারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রত্যাশিত বিক্রি এখনো শুরু হয়নি। যেগুলো বিক্রি হচ্ছে তার বেশির ভাগই ছোট আকারের। ব্যবসায়ীরা এবার পশুর দাম নিয়ে কিছুটা শঙ্কায় থাকলেও আশা করছেন আজ রোববার থেকে সবধরনের গরু বিক্রি বেড়ে যাবে।
সিরাজগঞ্জ থেকে ১২টি গরু নিয়ে এই হাটে এসেছেন ব্যবসায়ী রহমত মিয়া। তিনি বলেন, ‘এক দিন হলো হাটে এসেছি। এই সময়ে তিনটি গরু বিক্রি হয়েছে। এগুলো মাঝারি সাইজের। আশা করছি, বড়গুলা রবিবার বা সোমবার থেকে বিক্রি করতে পারব। এখন যারা আসছেন তাদের বেশির ভাগ দরদাম দেখতে আসছেন।’ তুরাগ এলাকা থেকে আসা ক্রেতা মহসিন মিয়া বলেন, ‘৬৫ হাজার টাকা দিয়া একটা ছোট ষাঁড় কিনছি। প্রথম দিনেই কিনলাম। পরে ভিড় বাড়বে। ঝামেলা কমাতে আগেভাগেই কিনে রাখলাম।’ হাটের ইজারাদার নূর হোসেন বলেন, প্রথম দিন ক্রেতারা তেমন আসেনি। ফলে বিক্রি কম। তবে আজ থেকে হাট জমে যাবে।
এদিকে হাটে নারী ক্রেতার সংখ্যাও কম নয়। কোরবানির পশু কিনতে নারী ক্রেতারা যাচ্ছেন হাটগুলোতে। তারা দেখছেন, পছন্দ করছেন। কেউ কেউ কিনে ফেলছেন হাতে সময় রেখেই। গতকাল পর্যন্ত ভিড় কম থাকার কারণে স্বাচ্ছন্দে ঘুরে গরু ছাগল দেখতে পারছেন তারা। দামদর করতেও সুবিধা হচ্ছে। দামে মিললে পছন্দের পশুটি কিনতে দেরি করছেন না অনেকেই। রাজধানীর গাবতলী, আফতারনগর, শাজাহানপুর, উত্তরাসহ বেশ কয়েকটি হাট সরেজমিনে ঘুরে নারী ক্রেতার দেখা মেলে। কিশোরী-তরুণী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সি নারীরা হাটে আসছেন কোরবানির পশু কিনতে।
হাট কর্তৃপক্ষ বলছেন, উচ্চবিত্ত নারীরাই তুলনামূলকভাবে হাটে আসেন বেশি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নারী ক্রেতার কাছে পশু বিক্রি করার সুবিধা আছে। তারা এতো যাচাই-বাছাই করেন না। পছন্দ হলে পশু নিয়ে যান। পুরুষরা তো দশ দোকানে যান, এক গরুই দশবার দামাদামি করেন।
গৃহিণী সামসুন্নাহার উত্তরার হাটে এসেছেন গরু কিনতে। তিনি বলেন, গরুর দাম অনেক বেশি। ৫০ হাজার টাকার গরু এক লাখ টাকা দাম চাচ্ছে।
মেরাদিয়ার হাটে খাসি কিনতে এসেছেন আলেয়া পারভীন। সাথে রয়েছে তার মেয়ে নুসরাত। তিনি বলেন, প্রতিবারই আমি আমার পছন্দমতো খাসি কিনি। হাটে যেতে ভালো লাগে। দেখি- এবার ১টা খাসি কিনব। ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে, খাসি কিনবেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছেন তারা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন