মিজানুর রহমান তোতা : যশোর ও খুলনার বিরাট এলাকার অভিশাপ ভবদহ সøুইস গেট। কিন্তু আশীর্বাদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ও সংশিষ্ট ঠিকাদারদের। ভবদহ সমস্যার সমাধানের নামে প্রজেক্টের পর প্রজেক্ট গ্রহণ করে যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি টাকা শুধু লুটপাটই হয়েছে, ন্যুনতম সমাধান হয়নি-এ অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্ত ও পানিবন্দী সাধারণ মানুষের।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দেরও অভিযোগ একই। ভবদহ সমস্যা জিইয়ে রেখে ভবদহ সরকারি অর্থ লোপাটের কারখানায় পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে যখন বিরাট এলাকা পানিবদ্ধ হয়ে রাস্তাঘাট, ফসলাদি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ঘরঘড় পানিতে ডুবে যায়। ঘটে দীর্ঘসময় মানবিক বিপর্যয়। এবারও তার ব্যতয় ঘটেনি। অবশ্য সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ড্রেজিংসহ পানি নিস্কাশন কাজ করায় পানিবদ্ধতার নিরসন হয়। পরবর্তীতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্তরা অভিশপ্ত ভবদহ সøুইস গেট তুলে দিয়ে বাস্তবসন্মত কার্যকরী প্রজেক্ট গ্রহণ করা জরুরি। একইসাথে এ পর্যন্ত কারা কিভাবে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে তার আদ্যপান্ত তদন্ত করে জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি তুলেছেন ভবদহ পানি নিস্কাশন কমিটির উপদেষ্টা বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা ইকবাল কবীর জাহিদ। পানি উন্নয়ন বোর্ড বরাবরই লুটপাটের অভিযোগের দায় এড়িয়ে যায় কৌশলে। যখনই বক্তব্য চাওয়া হয় তখনই বলা হয় ওইসময় তো অমুক কর্মকর্তা ছিলেন আমার জানা নেই। পরে যোগাযোগ করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডেও যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী মোবাইল ধরেননি। অফিস থেকে বলা হয় ট্রেনিংয়ে আছেন। পাউবো’র কেশবপুরের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুল মোতালেবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি বলেন ব্যস্ত আছি। তারপরও দু’একটি প্রশ্নের জবাব দেন কৌশলে। তিনি বলেন, ভবদহ আমার পার্ট নয়, মনিরামপুরে যোগাযোগ করেন। হরিহর নদীর কথা উল্লেখ করতেই তিনি বললেন আমি নতুন এসেছি কে কখন কত টাকার কাজ করেছে তার হিসাব আমার কাছে নেই। মনিরামপুর উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী শওকত হোসেন কয়েকটি প্রজেক্টের হিসাব দিয়ে বলেন, এবার একটি বড় প্রজেক্টের স্টাডি করতে বলেছে মন্ত্রণালয়। সময় দিয়েছে ৪ মাস। ইতোমধ্যে সমীক্ষা শুরু হয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধান কিভাবে হবে মাঠে নেমে জনসাধারণের মতামত গ্রহণ ও ভবদহ সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের সমীক্ষা কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি করা হয় না। সমীক্ষা করছে ইন্সটিটিউট অফ ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট (আইডব্লিউএম)। যার প্রধান পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা নুরুল আলা। সমীক্ষা সম্পর্কে জনসাধারণ অবহিত হন না। কাগজপত্রে মাঠে নামার কথা বলা হলেও আসলে তা হয় না। কাগুজে সমীক্ষা ও সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথ ব্যয় না হওয়ার কারণে প্রজেক্ট শেষ হয় কিন্তু কাজ হয় না। সংশ্লিষ্ট একটি সুত্র জানায়, সমীক্ষা ও প্রজেক্ট গ্রহণেও অর্থ ব্যয় হয় প্রচুর। তারপর পাউবো’র একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা কিছুটা কাজ দেখিয়ে বিল তৈরী এবং অর্থ উত্তোলন করে বলে অভিযোগ। ভবদহের ক্ষেত্রে জনসাধারণের মতামত, পাউবো’র কোন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা নেই। এমনকি রাজনৈতিক বিভাজন থাকলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদারী কাজের ক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় ঠিকাদার অভিন্ন। তাছাড়া সব সময় ক্ষমতাসীনরা নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের করা, নদী দখল, টিআরএম প্রকল্প ক্ষমতাসীনদের টানাটানিতে বন্ধ হওয়া ও পাউবো’র লাগামহীন দুর্নীতিসহ মানবসৃষ্ট দুর্যোগের শিকার হন লাখ লাখ মানুষ। পানিবন্দীরা বলা শুরু করেছেন ‘ত্রাণ চাই না, পরিত্রাণ চাই’, ‘পানি সরাও মানুষ বাঁচাও’।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সবুজ বিপ্লবের ঘোষণা দিয়ে ১৯৬০ সালের দিকে যশোরের সদর, মনিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর, খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার মধ্যবর্তী ভবদহ নামকস্থানে শ্রীনদীর উপর নির্মাণ করা হয় একটি বড় ¯ুইস গেট। একপর্যায়ে যশোর ও খুলনার মধ্যবর্তী প্রায় ২শ’ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৮ লক্ষাধিক মানুষের মরণ ফাঁদে পরিণত হয় ভবদহ ¯ুইস গেট। গেটটিতে মোট কপাট রয়েছে ৩৬টি। গেট সংলগ্ন শ্রীনদী, টেকা ও মুক্তেশ্বরী এই ৩টি নদী রয়েছে। ওই ¯ুইস গেট দিয়ে বিল কেদারিয়া, বিল বকর ও বিল আড়পাড়াসহ যশোর ও খুলনা এলাকার মোট ২৭টি বিলের পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিটি বর্ষা মৌসুমে বিল তীরবর্তী আশেপাশের শত শত গ্রামে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হতে থাকে। পরবর্তীতে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ভবদহ স্লুইস গেট চিহ্নিত হয় যশোর ও খুলনার বিরাট এলাকার দুঃখ হিসেবে। পানিবদ্ধ এলাকার সাধারণ মানুষের আন্দোলন শুরু হলে ১৯৯৪ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক ও কারিগরী সহায়তায় যশোর-খুলনা পানি নিষ্কাশন প্রকল্প (কেজিডিআরপি) গ্রহণ করা হয়। ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২৫৭ কোটি টাকা। সমুদয় অর্থ ব্যয় হওয়ার পরও পানিবদ্ধতার নিরসন হয় না। অভিযোগ ওই অর্থের বড় অংশই লুটপাট হয়। পর্যায়ক্রমে ২০০৭ সালে ৫৯ কোটি ৫৯লাখ টাকা, ২০১০ সালে ৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা, দফায় দফায় টিআরএমসহ ছোট ছোট প্রজেক্টে কোটি কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়। সর্বশেষ ভবদহ গেটের উত্তর পাশে শ্রীনদী ড্রেজিংএ চলতি বছর ১ কোটি ৭লাখ টাকার কাজ চলছে। পানিবন্দী মানুষের হৈ চৈ শুরু হলে একটি স্ক্যাভেটর দিয়ে হরিহর নদীতে ড্রেজিং হচ্ছে যা লোক দেখানো বলে জনগণ অভিযোগ করেছেন।
পানি বিশেষজ্ঞ, পর্যবেক্ষক, সংগ্রাম কমিটিসহ একাধিক সুত্র জানায়, ভবদহ ¯ুইস গেট সম্পুর্ণ তুলে দিয়ে ভবদহের আশেপাশের সব নদী খনন করে উজানের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং বিল কপালিয়াসহ খাল-বিলে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্টে (টিআরএম) চালু করে জোয়ার আধার সৃষ্টি ও শ্রীনদী, হরিহর নদী, টেকা নদী, মুক্তেশ্বরী নদীসহ তলদেশ ভরাট হওয়া নদীর বেড থেকে মাটি কেটে পাড় বাঁধানোর ব্যবস্থা ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে। ভবদহ স্লুইস গেটের কার্যকারিতা হারিয়ে গেছে। এই গেটের কারনে নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি নিষ্কাশন হতে পারে না। যার কারণে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
সরেজমিনে ভবদহের আশেপাশে পাটকাটিয়া, বয়ারঘাটা, ফুলবাড়িয়া, নেবুগাতি, হরিদাসকাঠি, সুজাতপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে গিয়ে লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এলাকাবাসীদের দাবী ছিল মুক্তেশ্বরী নদী খনন করা মাটি দিয়ে নদীর দুইপাড়ে বাঁধ দেয়া। কিন্তু নদী খনন না করে আবাদী জমির মাটি কেটে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তাছাড়া ভবদহের নীচে টেকা নদী খননের নামে তিন ভাগ করে ফেলা হয়েছে। এটিও পানি নিস্কাশনে বড় বাধা। এলাকাবাসীরা সমস্বরে দাবি তুলেছেন আর যেন সরকারী অর্থ কেউ লুটপাট করতে না পারে। বড় প্রজেক্ট নিয়ে যথাযথ কাজ করে ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা হোক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন