শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

সুন্দরবনের বিপর্যয়ে বিপন্ন রয়েল বেঙ্গল টাইগার

বিশ্ব বাঘ দিবস আজ

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ২৯ জুলাই, ২০২১, ১২:০১ এএম

প্রকৃতি ও মানুষের নানা আগ্রাসনে বিপর্যস্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। লবণাক্ততা, পলি পড়ার হার ও নদীভাঙন বৃদ্ধির পাশাপাশি ভারী নৌযান চলাচল ও দূষণ এবং মানুষের লোভাতুর থাবা ক্ষতিগ্রস্থ করছে এই বনকে। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে বুক দিয়ে যে সুন্দরবন আগলে রাখে সেই বন এখন ভাল নেই। আর সুন্দরবন ভাল না থাকলে ভাল থাকে না এদেশের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার। কারণ সুন্দরবনই যে তাদের একমাত্র আবাসস্থল। তাই তো সুন্দরবনের বিপর্যয়ের ফলে বাঘ ভালো নেই। বিশ্বব্যাপী বাঘের বিপন্নতার হাত ধরে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারও মহাবিপন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বিপন্ন এই বাঘকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে ও সচেতনতা বাড়াতে আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব বাঘ দিবস। করোনামহামারির কারণে এবারের বাঘ দিবসে বড় কোনো অনুষ্ঠান থাকছে না। তবে ওয়েবিনারে আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছে। আলোচনায় পরিবেশ বন ও আবহাওয়া পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করবেন।

নানান দূষণে সুন্দরবন আজ বিপর্যন্ত। হুমকির মুখে এর জীববৈচিত্র। বন সংলগ্ন এলাকায় শিল্প কারখানা স্থাপন, বনের মধ্য দিয়ে ভারী নৌযান চলাচল, পাচারের উদ্দেশ্যে বনের মধ্য বন্যপ্রাণী হত্যা, বিষ দিয়ে মাছ শিকার এবং নিয়ন্ত্রণহীন পর্যটনের কারণে ঘটছে দূষণ। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বনের গাছপালা, অন্য বন ও জলজ প্রাণীর ওপর। এছাড়া ঝড়-জলোচ্ছাসের প্রভাব, সুন্দরী ও গেওয়া গাছের আগামরা রোগও সুন্দরবনের ক্ষতির কারণ।

সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করলেও সেই এলাকার মধ্যে অর্ধশতাধিক ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সুন্দরবনের আশপাশের নদীতে একের পর এক কয়লা ও তেলবাহী জাহাজ ডুবছে। ফলে কয়লা এবং জ্বালানি তেলের রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ায় সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকার পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র হুমকির মুখে। সুন্দরবনের পাশেই রামপালে কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই কেন্দ্র নির্মাণ সুন্দরবনকে ক্ষতিতে ফেলবে না। অন্যদিকে পরিবেশবাদীরা এ বিষয়ে ঘোর আপত্তি তুলেছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল বলেন, ‘সুন্দরবনকে ধ্বংস করার নানা কর্মকান্ড চলছে। এ বনের চারপাশে গড়ে উঠছে বন ধ্বংসকারী নানা কলকারখানা। রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও সুন্দরবনের জন্য হুমকি বলে আমরা মনে করি। অথচ সরকার বিষয়ে কোন কর্ণপাত করছে না’।
ওয়াইল্ডটিমের প্রধান নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, হাজার হাজার মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। তাই বাঘের সংখ্যা সংরক্ষণে জনগণকে সম্পৃক্ত করা উচিত এবং রাজনৈতিক লোকদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে এতে সম্পৃক্ত করতে হবে।

বাঘ বাঁচাতে সুন্দরবনের ৬০ কিলোমিটার এলাকায় নাইলনের নেট বসাচ্ছে বন বিভাগ। এর মধ্যে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের জয়মনির ঘোল থেকে দাসের ভাড়ানি পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার এবং পশ্চিম বন বিভাগের আওতায় কইখালী থেকে কদমতলা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার বসানো হচ্ছে। পাশাপাশি বাঘের সংখ্যা বাড়াতে ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। বন বিভাগ জানায়, চলতি বছরের মধ্যে অনুমোদন পেলে ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ করা যাবে প্রকল্পটি।

নেট প্রকল্পের পরিচালক জাহিদুল কবির বলেন, দুটি কারণে নাইলনের নেট বসানো হচ্ছে। প্রথমত মানুষ ও বাঘের মধ্যে দ্ব›দ্ব বা সংঘর্ষ কমানো এবং দ্বিতীয়ত সুন্দরবনে এখন যেভাবে যত্রতত্র মানুষ ঢুকে পড়ে, সেটা বন্ধ করা। ভারতের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশটিতে নাইলনের নেট দেওয়ায় তারা বেশ সুফল পেয়েছে। সেখানে মানুষ ও বাঘের মধ্যকার সংঘর্ষ কমে এসেছে।

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। সরকারের ২০০৪ সালে পরিচালিত বাঘশুমারি অনুসারে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশটি ৪৪০টি বাঘের আবাস ছিল। ২০১৫ সালের বাঘশুমারির প্রতিবেদন অনুসারে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে মাত্র ১০৬টি বেঙ্গল টাইগার পাওয়া যায়। পরে, ২০১৭-২০১৮ বাঘশুমারিতে সেখানে ১১৪টি বাঘ শনাক্ত করা হয়। বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০০১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৪৮টি বাঘ মারা গেছে। এর মধ্যে ২২টি সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগে এবং ১৬টি পশ্চিম বিভাগে মারা যায়। এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ১০টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করে।

বাঘ সংরক্ষণে বিশ্বব্যাংকসহ গ্লোবাল টাইগার ইনিশিয়েটিভ, গ্লোবাল টাইগার ফোরাম ও উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় সরকার দেশে জাতীয় বাঘ পুনরুদ্ধার কর্মসূচি (এনটিআরপি) এবং বাংলাদেশ বাঘ কর্মপরিকল্পনা (২০০৯-২০১৭) বাস্তবায়ন করছে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং জামিন অযোগ্য এ আইনে বাঘশিকারি বা হত্যাকারীর দুই থেকে সাত বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন