মিজানুর রহমান তোতা : সবুজের মাঝে সাদা রজনীগন্ধা আর লাল গোলাপ হলুদ গাঁদার চাদর পাতা মনমাতানো, সে এক অভুতপূর্ব নয়নাভিরাম দৃশ্য। বিস্তীর্ণ এলাকার মাঠে মাঠে লাল, হলুদ, খয়েরী ও হলুদসহ রং বেরং এর বাহার। যতদুর চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। সারাদেশের মধ্যে ফুল উৎপাদনে বিপ্লব ঘটানো যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী এখন ফুলের রাজ্য হিসেবে পরিচিত। উৎকর্ষতার প্রতীক ফুল সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের জীবনে মিশে আছে। ফুল শুধু সৌন্দর্য কিংবা মিষ্টি সুবাতাস ছড়ায় না। বিশাল বাণিজ্যও হয়। গদখালীর ফুল চাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম মঙ্গলবার দৈনিক ইনকিলাবকে জানালেন, মানসম্পন্ন বীজ, চারা ও কলম ফুলচাষিদের মাঝে সরবরাহ এবং উৎপাদিত ফুল বিদেশে রফতানীর প্রতিবন্ধতা দুর করার সরকারি উদ্যোগ নেয়া হলে ফুল উৎপাদনের পাশাপাশি রফতানীতেও রেকর্ড সৃষ্টি হবে। কিন্তু ফুল রফতানী নীতিমালার অভাবে বিদেশে যাচ্ছে সবজি হিসেবে। তার কথা, বহুবারই আবেদন নিবেদন করা হয়েছে, হচ্ছে, হবে এমন আশ্বাসে আটকে রয়েছে বহুদিন। সরকার নজর দিলে সম্ভাবনাময় ফুল শিল্পটির এগিয়ে যাবে। রাখতে পারবে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভুমিকা। সমৃদ্ধ হবে বৈদেশিক মুদ্রাভা-ার।
যশোরের ফুল উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টির গদখালীতে গিয়ে দেখা গেছে, রজনীগন্ধার পাশাপাশি ঝাউ কলম ফুল, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, লিলিয়াম, লাল গোলাপ, সাদা গোলাপ, কালো গোলাপ, হলুদ গোলাপ, গাঁদা, জবা ও জুঁইসহ মানসন্মত বিভিন্ন ফুল উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু চাষিদের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা। তাদের কথা, শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ফুলের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু চাহিদানুযায়ী সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ফুলকে ঘিরে চাষ, পরিচর্যা, ফুল তোলা, বান্ডিল করা, সংরক্ষণ, পরিবহন, ক্রয় ও বিক্রয়সহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রয়েছে লাখ লাখ মানুষের বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। ফুলের মান বৃদ্ধি, সংরক্ষণ, চাষিপর্যায়ে আধুনিক পদ্ধতি ও কলাকৌশলের জ্ঞানের অভাব এবং সুষ্ঠু বাজারজাতকরণে বহুমুখী সমস্যার কারণে বিরাট সম্ভাবনার খাতটি ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। উৎপাদকদের পর্যাপ্ত ঋণ দেয়া, বিপনন ব্যবস্থার সহায়ক অবকাঠামো গড়ে তোলা ও গুণগত মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা রয়েছে তা মাঠপর্যায়ে তদন্ত করে সমাধানের ব্যবস্থা নেয়া হলে ফুলচাষিদেও মুখে হাসি ফুটবে। কিন্তু এ ব্যাপাওে বরাবরই কোন জোরদার উদ্যোগ নেই। তবে আশার কথা, ফুলের রাজ্যে একটি ফুল গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন হতে যাচ্ছে। যেটি করছে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি। ফুল চাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি আরও জানালেন, গত ১২ জানুয়ারী কৃষি মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। তাতে আলাদা প্রকল্প গ্রহণ ও নীতিমালা করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঢাকায় একটি পারমানেন্ট মার্কেট করারও পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এখন দরকার এসবের বাস্তবায়ন। তার কথা, শুধু চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে শহীদ দিবস, ভালোবাসা দিবস ও বসন্তকে ঘিরে ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এবার উৎপাদনও হয়েছে ব্যাপক। সারাবছরই যশোরে ফুল উৎপাদন হয়। গদখালীর বিস্তীর্ণ এলাকার মাঠে অন্য কোন ফসলের আবাদ হয় না।
সংশ্ল্ষ্টিদের কথা, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোন ন্যুনতম ক্রেডিট নেই। নেই কোন পৃষ্টপোষকতা কিংবা সহযোগিতা। সম্পুর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে চাষিরা ফুল উৎপাদনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। কিন্তু বিপ্লবের সুফল পাাচ্ছেন না চাষিরা। সৌন্দর্যের পিপাসা মিটানোর জন্য দিনরাত যারা পরিশ্রম করছেন তাদের পেটের ক্ষুধা মিটছে না ফুল বিক্রি করে। দুশ্চিন্তার ছাপ ফুলচাষিদের চোখেমুখে। ফুল ব্যবসায়ীরা জানালেন, বর্তমানে কাতার, দুবাই, সউদী আরবসহ বিভিন্ন দেশে চাহিদার তুলনায় একেবারেই কম যশোরের ফুল রফতানী হচ্ছে। সরকার উদ্যোগী হলে অনায়াসেই ফুল রফতানী করে কাড়ি কাড়ি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। তাতে ফুলচাষিরা কৃষির এই খাতটিকে আরো এগিয়ে নিতে পারতেন। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় একচেটিয়া ফুল ব্যবসা করে লাভবান হওয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বেঙ্গালোর, পুনা ও তামিলনাড়–র চেয়ে যশোরসহ দেশের বিভিন্নস্থানে উৎপাদিত রজনীগন্ধাসহ প্রায় সব ফুলের মান খুবই উন্নত এবং রং উজ্বল ও হৃষ্টপুষ্ট। রজনীগন্ধা ও গ্লাডিওলাস উৎপাদনে বিরাট সাফল্য আসার পর রেকর্ড সৃষ্টির এলাকা যশোরে এখন পুরোদমে চাষ হচ্ছে জারবেরা ফুল। বিদেশ থেকে বীজ ও চারা আমদানী করে শাপলা ফুলের মতো দেখতে লিলিয়াম ফুল, চন্দ্রমল্লিকার মতো কার্ণিশন ও কাটাবিহীন স্টিক গোলাপ চাষের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ফুল রাজ্যে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সারাদেশের ১৯টি জেলায় ৬ সহস্রাধিক হেক্টর জমিতে রজনীগন্ধাসহ বিভিন্ন ফুল চাষ হচ্ছে। যার সিংহভাগই যশোর গদখালী এলাকায়। যশোর-বেনাপোল সড়কের গা ঘেষা ঝিকরগাছার গদখালী এলাকার মাঠে মাঠে বারোমাসই থাকে নানা জাতের ফুল আর ফুল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন