দেশে এবারো ধানের বাম্পার ফলনের আশা করা হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের সøুইসগেটগুলো খুলে দেয়ায় উজানের ঢলে দেশের বিশাল এলাকা প্রলম্বিত বন্যার শিকার হয়েছে। পাশাপাশি হাজার হাজার পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যশোরের ভবদহে স্থায়ী পানিবদ্ধতার কারণে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কয়েক নদীতে তৃতীয় দফা পানিবৃদ্ধির আশঙ্কা থেকে আবারো বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বৃষ্টি-বন্যার এসব নেতিবাচক সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাবের পাশাপাশি কিছু ইতিবাচক ফল রয়েছে। বন্যায় কৃষিজমিতে নতুন পলির যে স্তর পড়েছে তা চলতি মওসুমে ধানের বাম্পার ফলনে সহায়ক হয়েছে বলে মনে করছেন দেশের কৃষিবিদরা। তবে বৃষ্টি-বন্যা হোক বা না হোক, ইরি-বোরো-আমনসহ আমাদের কৃষিতে বাম্পার ফলন এবং খাদ্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। স্বাধীনতাত্তোর সাড়ে চার দশকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশী বৃদ্ধি পেলেও ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা পূরণ করে দেশকে খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার কৃতিত্ব এ দেশের কৃষকদের। ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান নিশ্চিত রাখতে এ দেশের কৃষকদের অবদানকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই। হাজার বছরের ধারাবাহিক বংশানুক্রমিক অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও নিরলস পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে আমাদের কৃষকরা বাম্পার ফলন ফলিয়েও ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না। তাদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ খুবই অপ্রতুল।
এবারের বন্যা আমাদের কৃষির জন্য শাপেবর হয়েছে। বানের পানির সাথে ভেসে আসা পলিমাটির কারণে বোরো, আমনধানসহ আগামী মওসুমের শীতকালীন শস্যে ভাল ফলনের আশা করা হচ্ছে। এ জন্য বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আর্থিক প্রণোদনাসহ ভর্তুকি ও সুলভ মূল্যে চারা, বীজ, সারসহ সেচব্যবস্থা নিশ্চিত করা আবশ্যক। উজানের ঢল এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টি দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষিজমিতে আটকে থাকা লবণাক্ততা ধুয়ে মুছে বের করে দেয় এবং পলির আস্তরণ নতুন ফসলে বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা অনেক বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু যে কৃষকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, বীজ, সার, সেচ ও কীটনাশকে বিঘাপ্রতি হাজার হাজার টাকা পুঁজি খাটিয়ে ফসলের উৎপাদন নিশ্চিত করে, সে সব কৃষক প্রতি বছরই ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাম্পার ফলনের পরও কৃষকের মুখে হাসি থাকে না, থাকে প-শ্রম ও পুঁজি হারানোর হতাশা। রাজপথে ফসল ঢেলে ন্যায্য মূল্যের দাবিতে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে দেখা যায় কৃষকদের। ফসল বিক্রি করে কৃষক তার উৎপাদন খরচ উঠাতে না পারলেও কৃষকের মূল্য এবং ভোক্তা পর্যায়ের খুচরা মূল্যের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। অর্থাৎ ভোক্তারা বাজার থেকে প্রতি কেজি ৪৫-৬০ টাকা দরে চাল কিনতে বাধ্য হলেও নিজ শ্রম ও পুঁজি খাটিয়ে খাদ্য উৎপাদনে কৃতিত্বের দাবিদার কৃষকরা তার অর্ধেক মূল্যও পাচ্ছে না। প্রতিবছর মধ্যস্বত্বভোগিরা কৃষকদের বঞ্চিত করে বিপণন ব্যবস্থায় কারসাজি করে মূল্য বাড়িয়ে শত শত কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে।
আমাদের কৃষক এবং সাধারণ মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে। কৃষি উৎপাদন থেকে তৈরী পোশাক শিল্প, বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে পাঠানো রেমিটেন্স এবং সাম্প্রতিক ঈদুল আযহায় দেশীয় খামার থেকে অর্ধকোটি পশুর যোগান নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত। তবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ থেকে শুরু করে মজুদ ও বিপণন পর্যন্ত সরকারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়ক ভূমিকা ছাড়া কোন উদ্যোগই চূড়ান্ত সাফল্য পায় না। বাম্পার ফসল উৎপাদনের পর কৃষকের ন্যায্যমূল্য এবং ভোক্তাদের চাহিদা ও ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সরকারের দায়িত্ব। একই সাথে কৃষকরাও সমবায়ভিত্তিক উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলতে পারে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমির উর্বরতা হ্রাস এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, শিল্পায়ণ, নগরায়ণ, কৃষিজমি কমে যাওয়ার কারণে সারাবিশ্বেই কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তার অনিশ্চয়তার পাশাপাশি কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় জিডিপিতে কৃষির অবদান বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সত্ত্বেও আমাদের দেশের কৃষকরা কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ায় হতাশ হয়ে আবাদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের মত ঘনবসতিপূর্ণ দরিদ্র দেশের জন্য এটি এক অশনি সংকেত। খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা জাতীয় নিরাপত্তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের কোটি কোটি কৃষককে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত রেখে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষক পর্যায়ে সরকারী ধানচাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে রাইস মিল মালিকও মধ্যস্বত্বভোগিদের কারসাজি ও অতি মুনাফাবাজি বন্ধ করতে হবে। বাম্পার ফলনের সুফল কৃষক থেকে শুরু করে দেশের সব মানুষ লাভ করুক, এটাই সকলের প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন