তারিখটা ৬ আগস্ট, ১৯৪৫। ৬ আগষ্ট মানব ইতিহাসের ভয়াবহতম এবং লজ্জার হিরোশিমা দিবস। ৭৬ বছর আগে এই দিন ক্ষমতার লড়াইয়ের চূড়ান্ত বিভৎসতা প্রত্যক্ষ করে বিশ্ব। পারমানবিক বোমায় ধ্বংস হয় জাপানের হিরোশিমা নগরী। সঙ্গে সঙ্গেই মরা যায় ৮০ হাজার মানুষ। পরে মৃতের সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়ায়। এখনো সেই ভয়াবহতার জের টানতে হচ্ছে মানবজাতিকে। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’র বার্তা নিয়ে আজও রক্তস্নাত দিনটিকে স্মরণ করছে বিশ্ব।
তখন চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ভয়ংকর নির্দেশটা আগেই দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল। হিরোশিমায় আকাশে মার্কিন বোমারু বিমান। নাম তার ‘এনোলা গে’। বয়ে নিয়ে আসে ৬০ কিলোগ্রাম ওজনের ইউরেনিয়াম-২৩৫ সমৃদ্ধ বোমা-লিটল বয়। সকাল সোয়া ৮টা। হিরোসিমার মাটি স্পর্শ করে ছোট্ট বালক। নিমিষেই বিস্ফোরণ। ছাতা আকৃতি ধোঁয়ার কুন্ডলি। ভয়বহতম এ হামলায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় দেড় লাখ মানুষ নিহত হন। মাটির সঙ্গে মিশে যায় শহরের বেশিরভাগ স্থাপনা। নিমিষেই সাজানো একটি নগরী ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়। বোমা হামলার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় তেজস্ক্রিয়তার কারণে বছর শেষে আরও ৬০ হাজার মানুষ মারা যান। ভয়াবহ এই বোমার তীব্রতা শেষ হয়নি ৭৬ বছর পরও। বেঁচে থাকা অনেকেরই দেহে এখনো তেজস্ক্রিয়তার ক্ষত।
তারপরও থেমে নেই পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, অন্তত ৯টি দেশের কাছে রয়েছে ৯ হাজার পরমাণু বোমা। কঠোর গোপনীয়তায় পরমাণু অস্ত্রের ভান্ডার সমৃদ্ধ করা হচ্ছে। চলছে আরো বিধ্বংসী বোমা তৈরির পরিকল্পনা। যদিও যুদ্ধ নয় শান্তির বার্তা প্রচারেই অগ্রগামী বিশ্বের এসব ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালে হিরোশিমাকে ‘শান্তির শহর’ ঘোষণা করা হয়। হিরোশিমায় নির্মাণ করা হয় শান্তির স্মৃতি পার্ক। এরপর থেকে প্রতিবছর ৬ আগস্ট শোক ও বেদনার মধ্য দিয়ে দিনটিকে স্মরণ করে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসী। একইসঙ্গে এদিন যুদ্ধবিরোধী প্রচার প্রচারণা চলে এবং পারমাণবিক বোমামুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় নেওয়া হয়।
সাংবাদিক নোমান সেলিম তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, জাপানের হিরোশিমা জাদুঘরে সংরক্ষিত ঘড়িটির কাঁটা সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে থেমে রয়েছে। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট এটির কাঁটা চিরতরে থেমে যায়। ঘড়িটির মালিকের সাথে আরো লাখো নগরবাসীর জীবনের আলোও নিভে গিয়েছিল একই সময়ে। অন্য দশটা দিনের মতোই ওইদিনও সূর্যটা পুবাকাশে স্বর্ণালি মিষ্টি কিরণ ঝরিয়ে নতুন দিনকে স্বাগত জানায়। কর্মচঞ্চল হিরোশিমাবাসী নতুন দিনের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। হাজারো শিক্ষার্থী ব্যাগ কাঁধে স্কুলের পথে। এমনই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছোঁড়া পারমাণবিক বোমা পুরো হিরোশিমা শহরটি ধূলিসাৎ করে দেয়। থেমে যায় প্রাণের স্পন্দন।
তিনি লেখেন, মার্কিনীদের ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হিরোশিমা টাওয়ারের অদূরে একটি বিশাল জাদুঘর রয়েছে। জাদুঘরটিতে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্টের বর্বর ধ্বংসযজ্ঞের বিভীষিকাময় চিহ্নগুলো বর্ণনাসহকারে থরেথরে সাজানো। বোমাটি বিস্ফোরিত হওয়ার পর শহরের অবস্থা কেমন হয়েছিল, জাদুঘরের একটি বিশাল অংশজুড়ে তার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। জাদুঘরটি পরিদর্শন শেষে বের হওয়ার সময় দর্শনার্থীদের সবাইকে নির্বাক হয়ে চোখ মুছতে দেখা যায়।
বোমা বিস্ফোরণের ইতিবৃত্ত তুলে ধরে লন্ডনপ্রবাসী বাংলাদেশি আইনজীবী ব্যারিস্টার ফারাহ খান তার ফেসবুকে আইড থেকে একটি লেখা পোস্ট দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ভয়াবহ এই পরমানু বোমা তৈরী ও বিস্ফোরণ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা রয়েছে। এর পক্ষে যেমন যুক্তি আছে, তেমনি এর বিপক্ষে রয়েছে কড়া ক্রোধ ও ধিক্কার। আমেরিকার শরণার্থী হিসেবে বসবাস করা হাঙ্গেরির বিজ্ঞানী ড. লিও জিলার্ড সর্বপ্রথম এই বোমা তৈরির উদ্যোগ নেয়। জার্মানি নিউক্লিয়ার বোমা বানাচ্ছে এমন খবরে ড. জিলার্ড পৃথিবী খ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কে অবহিত করে এবং অনুরোধ করে আইনস্টাইন যেন তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট কে এই মর্মে একটি চিঠি লিখে এবং জার্মানির আগে আমেরিকা যেন নিউক্লিয়ার বোমা বানাতে পারে সে জন্য কাজ শুরু করে। আইনস্টাইনের চিঠি পেয়েই প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করে। যদিও প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের নির্দেশে এই পরমানু বোমাগুলো নিক্ষেপ করা হয়।
একটি বিধ্বস্ত শহর কীভাবে ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিরোশিমা। প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক হিরোশিমা ভ্রমণে যান। পরমাণু বোমা হামলার পর যে শহর সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, সেই শহর এখন সবুজ গাছপালা আর ছায়ায় ভরা। পরিষ্কার-পরিছন্ন রাস্তাঘাট ও গগনচুম্বি দালানকোঠা যেন পরমাণু বোমা হামলার সেই ভয়াবহতাকে প্রতিনিয়ত ভুলে থাকতে চায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন