সরকার আদম আলী, নরসিংদী থেকে : নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবাধে আমদানী ও বিক্রি হচ্ছে প্রাচীন ভারতীয় যুদ্ধাস্ত্র খ্যাত মারাত্মক সব লৌহাস্ত্র ও ইস্পাত নির্মিত অস্ত্র।
কুড়াল পরশু টাংগি, তলোয়ার, কিরিচ, হাসুয়া, ছোট বড় ছুরি, চাকু নামের এসব প্রাচীন ভারতীয় যুদ্ধাস্ত্র আধুনিক সংস্করণে বিভিন্ন নামে নিয়ে ভারত মায়ানমার সীমান্তের বৈধ অবৈধ পথে ব্যাপকভাবে দেশে প্রবেশ করছে। আর এসব ধাতব অস্ত্র কিনে নিয়ে পেশাদার অপরাধীরা কুপিয়ে কচুকাটা করে মানুষ হত্যা করছে। হাত বাড়ালেই মিলছে চকচকে সাদা ইস্পাতের তৈরী চাপাতি আর চাইনিজ কুড়াল। এই চাপাতি ও চাইনিজ কুড়ালের কোপে প্রাণ হারিয়েছে নরসিংদীর বিশিষ্ট ওষুধ ব্যবসায়ী ও নরসিংদী কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সভাপতি ডা. সেলিমসহ বহুসংখ্যক মানুষ।
জানা গেছে, ১০ বছর আগেও নরসিংদীতে দেশীয় ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ি ছিল। লেদ মেশিনের তৈরী ও চোরাই পথে আমদানীকৃত রিভলবার ও পিস্তল নামের এসব ক্ষুদ্রাস্ত্র কিনে পেশাদার অপরাধীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় থেকে গুলী করে মানুষ মারতো। তারা মাদক ব্যাবসার কাজে ও এসব ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহার করতো। যেখানেই মাদক পাওয়া যেতো সেখানেই পাওয়া যেতো রিভলবার, পিস্তল, পাইপগানের মত ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র। সন্ত্রাসীরা এসব দিয়ে ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত পাঁচশতাধিক মানুষ হত্যা করে।
সাম্প্রতিককালে অপরাধীরা ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের মাত্রা কমিয়ে এখন ব্যবহার করছে চাপাতি, চাইনীজ কুড়াল, ইউরোপীয় চাকু, ভিয়েতনামী সামুরাই, ছোট আকৃতির তলোয়ার, ছোট বড় আকৃতির ছুরি ও কিরিচের মত প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ধাতব নির্মিত অস্ত্রাদি।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একটি ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রের পিছনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহের গোয়েন্দা নজরদাবী থাকে। একটি ক্ষুদ্রাস্ত এক হাত থেকে আরেক হাতে গেলে আইন প্রয়োগকারীরা তাদের চরদের মাধ্যমে এর গতিবিধি লক্ষ্য করতে পারে। কিন্তু ধাতব অস্ত্রের পিছনে ততটা নজরদারী থাকে না। একটি ক্ষুদ্রাস্ত্র কোনো সন্ত্রাসীর হাতে থাকলে সে যতটা বেপরোয়া হয়ে যায়, একটি লৌহাস্ত্র থাকলে ততটা বেপরোয়া হতে পারে না। আগ্নেয়াস্ত্রধারীরা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের সময় যতটা উদ্বিগ্ন থাকে লৌহস্ত্র ব্যবহার করতে গিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন থাকে না। তাছাড়া আগ্নেয়াস্ত্রসহ ধরা পড়লে রাষ্ট্রীয় আইনে সাজার যে বিধান রয়েছে ধাতব অস্ত্র ধরা পড়লে সেই সাজার ভয় নেই।
এসব ভেবে চিন্তেই অপরাধীরা এখন তাদের গডফাদারদের পরামর্শে ক্ষুদ্রাস্ত্রের ব্যবহার কমিয়ে ধাতব অস্ত্র ব্যবহার করছে। তবে ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র যে ব্যবহার করছে না তা নয়। একটি গ্যাঙ’র মধ্যে ১০টি চাপাতি বা চাইনিজ কুড়াল থাকলে সেখানে তাদের ডিফেন্ডার হিসেবে একজন ক্ষুদ্রাস্ত্রধারী থাকছে। বিপদ খাড়া না হলে ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে না। এ ব্যাপারে স্থানীয় অপরাধ বিশেষজ্ঞদের সাথে কথাবলে জানা গেছে, প্রাচীন ভারতীয় যুদ্ধাস্ত্রগুলো ছিল আদিম যুগের পাথরাস্ত্রের লৌহ সংস্করন। এসব লৌহাস্ত্র এখন আধুনিক ইস্পাতাস্ত্রে পরিনত হয়েছে। এখন চাইনীজ কুড়াল নামে যে অস্ত্রটি আমদানী হচ্ছে, প্রাচীন ভারতে এর নাম ছিল পরশু। কোন কোন স্থানে টাংগিও বলা হতো। হিন্দু পুরাণে বলা হয়েছে যমদগ্রি ঋষির পুত্র বিষ্ণু ষষ্ঠ অবতার নাকি এই কুড়াল বা কুঠার দিয়ে ২১ বার ক্ষত্রিয়কূলকে ধ্বংস করে ছিলেন। চাপাতি নামক অস্ত্রটি চায়না ও মায়ানমার থেকে আমদানী হচ্ছে। অত্যন্ত ঝক ঝকে স্টিল নির্মিত এই অস্ত্রটির প্রাচীন ভারতীয় নাম ছিল কোবা। তখন তৈরী হতো লোহা দিয়ে। এখন স্টিল দিয়ে ছোট আকৃতি করে তৈরী করা হয়। এইসব চাপাতি প্যান্টের পকেটে কিংবা কোমড়ে গুজে সন্ত্রাসীরা স্বাচ্ছন্দে চলা ফেরা করে। কোথাও কোনো গন্ডগোল লাগলেই সন্ত্রাসীরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মানুষকে কচুকাটা করে দেয়। এর আরেকটি সংস্করন হচ্ছে সামুরাই। এটি প্রাচীন ভারতে নাম ছিল হাশুয়া। এই হাশুয়া দিয়ে এক কোপেই মানুষের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলা যেতো। তখন হাশুয়ার আকৃতি ছিল অনেকটা কাস্তের মত। এখন সেটা সোজা হয়ে নাম হয়েছে সামুরাই। এর আগা তেসরাকৃতির কিন্তু আগা তীক্ষè ও মোটা। প্রযুক্তিগত কারণেই এই সামুরাই দিয়ে এক কোপে হাড় মাংস শরীর থেকে আলাদা করে দেয়া যায়। নরসিংদীর বীরপুরের একজন সন্ত্রাসীকে হত্যার সময় এই সামুরাই দিয়ে এক কোপে চিবুক ও চোয়ালের হাড়সহ মাথা দ্বিখন্ডি করে দেয়া হয়েছিল। এমনিভাবে বহুসংখ্যক মানুষ এসব অস্ত্রের ঘায়ে নিহত হয়েছে। গুপ্তহত্যায় ব্যবহৃত হচ্ছে এসব বিদেশী ইস্পাতাস্ত্র। এসব অস্ত্র এখন নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন হাডওয়্যারের দোকানে ব্যাপকভাবে বিক্রি হচ্ছে।
সামনে লোহা লক্কড়ের দেশীয় অস্ত্র সাজিয়ে সামনে দু’একটা চাইনিজ কুড়াল মডেল হিসেবে রেখে অবাধে বিক্রি হচ্ছে এসব অস্ত্র। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কুরবানীর পশু জবাই ও হাড় মাংস কাটার জন্য এসব অস্ত্রাদী আমদানী করা হয়। কুরবানীর ঈদ এলেই এসব অস্ত্রের ব্যাপক আমদানী ঘটে। আসলে গরু কাটার কাজে চাইনিজ কুড়ালের কোন ব্যবহার হয় না। চাপাতিরও ব্যবহার হয় না। না ব্যবহার হয় সামুরাই’রও। অথচ নরসিংদী সহ দেশের হাডওয়্যারের দোকানগুলোতে এসব মারনাস্ত্রের ব্যাপক বেঁচা কেনা হচ্ছে।
একএকটি চাপাতি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দরে। চাইনিজ কুড়াল বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা দরে। সামুরাই বিক্রি হচ্ছে ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা দরে। সন্ত্রাসীরা অত্যন্ত সহজেই এসব অস্ত্র কিনে নিতে পারছে। বিক্রেতারা বলছে তাদের এসব অস্ত্র আমদানীর লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু দেখানোর কথা বললে তারা তা দেখাতে পারছে না। এমনিভাবে তলোয়ার, কিরিচ, ১৮ ইঞ্চির চেয়ে লম্বা লম্বা ছুরি অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে। এ লম্বা লম্বা ছুরিগুলো বিক্রি হচ্ছে বেশীরভাগ চরাঞ্চলে। নরসিংদীর নিলক্ষারচরসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলের লাঠিয়ালরা এসব ছুরি, চাইনজি কুড়াল বেশী করে কিনে নিচ্ছে। ছুরি দিয়ে মানুষ খুন করছে। আর চাইনিজ কুড়াল দিয়ে মানুষের বাড়ী-ঘরের টিন কাটা কুপিয়ে ফালা ফালা করে দিচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন