শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং যেনো মৃত্যুফাঁদ

সারাদেশে ১৭৬১টি অনুমোদনহীন : ২২৯৯টিতে রক্ষী নেই : ৩ বছরে দুর্ঘটনা ঘটেছে মোট ৮৩৭টি

প্রকাশের সময় : ১ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : অবৈধ ও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং কিছুদিন পর পর কেড়ে নিচ্ছে তাজা প্রাণ। তারপরেও টনক নড়ছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। একটা দুর্ঘটনা ঘটলেই রেলক্রসিং নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা। কিছুদিন পরে আবার ভুলে যান। বর্তমানে রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কিছু ট্রেনের রানিং টাইম কমানো হয়েছে। এতে করে অবৈধ ও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংগুলো আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আলাপকালে কয়েকজন ট্রেন চালক অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে তাদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেছেন, আমরা রেলপথ দেখেই বুঝতে পারি সামনে কোন কোন ধরনের ক্রসিং আছে। অরক্ষিত ক্রসিংগুলোর আগে তাই ট্রেনের গতি কমানো ছাড়া উপায় থাকে না। সাবধানতার পরেও যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে বলে তারা জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সারাদেশে রেল নেটওয়ার্কে মোট ২ হাজার ৫৪১টি লেভেল ক্রসিং আছে। যার মধ্যে অনুমোদিত ক্রসিংয়ের সংখ্যা মাত্র ৭৮০টি। বাকি ১ হাজার ৭৬১টিই অনুমোদনহীন। আবার ৭৮০টি অনুমোদিত ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ২৪২টিতে রক্ষী বা গেউটকিপার আছে। ৫৩৮টি অনুমোদিত ক্রসিংয়ে রক্ষী বা গেউটকিপার নেই। অর্থাৎ আনম্যান হিসেবে রয়েছে মোট ২ হাজার ২৯৯টি লেভেল ক্রসিং। এতে করে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। ক্ষতি হচ্ছে রেল তথা দেশের সম্পদের।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ট্রেনকে মানুষ এখনও নিরাপদ ভ্রমইের জন্য উপযুক্ত মনে করে। অথচ ট্রেনের নিরাপদে চলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ। এই রেলপথকে ঝুঁকিমুক্ত রাখার জন্য লেভেল ক্রসিংগুলোকে সুরক্ষিত করা জরুরী। পরিসংখ্যান বলছে, গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ের প্রতি খুব একটা নজর নেই রেল কর্তৃপক্ষের। বরং প্রতিনিয়ত সারাদেশেই অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা বাড়ছে। রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কোন স্থানে নতুন রেললাইন নির্মাণ করলে প্রয়োজনে লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করে সেখানে রক্ষী বা গেউটকিপার নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু রেলকে না জানিয়ে বা অনুমোদন না নিয়ে এলহিজইডি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও রেল লাইনের উপর লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করে থাকে। যা রেলওয়ের আইনে নিষিদ্ধ। এক সময় এই প্রবণতা এতো বেশি ছিল যে রেল কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এসব ক্রসিংয়েই এখন প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণহানি ঘটছে। রেলের সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। সূত্র জানায়, অবৈধ ও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ শতাধিক মামলা করেছে। যেগুলো এখন বিচারাধীন আছে। কোনো কোনা মামলা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কারণে মাঝপথে ঝুলে আছে। পক্ষান্তরে লেভেল ক্রসিংগুলো মৃত্যুফাঁদ হয়ে ঠিকই রেল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে (বিআর) ফেসবুক পেজের প্রধান নির্বাহী সাইফুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, দুর্ঘটনা এড়াতে এসব অবৈধ লেভেল ক্রসিং নির্বাহী আদেশে বন্ধ করা উচিত। এর বাইরে আসলে কোনো পথ খোলা নেই। তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলোতে রেল কর্তৃপক্ষ ‘সতর্কীকরণ’ সাইনবোর্ড টানিয়ে তাদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে। এগুলো গাড়ির চালক বা জনসাধারণ মানে না। যেখানে গেইটম্যান দিয়েও দুর্ঘটনা এড়ানো যাচ্ছে না সেখানে শুধু একটা সাইনবোর্ড কতোটা নিরাপদ? সড়ক পরিবহন বিভাগের মোটর ভেহিকেল আইনের ২৪ ধারায় বলা আছে- রেললাইনের ওপর দিয়ে পার হওয়ার সময় ধীরে এবং দেখে পার হতে হবে। এই ধারা কেউ মানে না বলেই দুর্ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, রাজধানী ও এর আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের ২৩টিরই কোনো অনুমোদন নেই। এ কারণে ট্রেনগুলো নির্ধারিত গতিতে চলতে পারে না। আলাপকালে কয়েকজন চালক বলেন, ঢাকা থেকে ট্রেন ছাড়ার পরে ট্রেনের গতি বাড়াতেই ভয় লাগে। না জানি কোথাও লেভেল ক্রসিংয়ের উপর গাড়ির সারি রয়েছে এই ভয় কাজ করে মনে। সে কারণে আসলে নির্ধারিত গতিতে ট্রেন চালানো যায় না। এতে করে যাত্রীদের যেমন অসুবিধা হয় আমাদেরও সময় মেলাতে গিয়ে কষ্ট হয়। জানা গেছে, অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের সাথে সরক্ষিত লেভেল ক্রসিংগুলোতেও রক্ষী বা গেইটকিপাররা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। এতে করে ঝুঁকি আরও বেশি। কারণ একজন চালক আগে থেকে জানছেন যে, সামনের ক্রসিংয়ে গেইটম্যান আছে। কিন্তু সামনা সামনি এসে দেখলেন গেইট খোলা-গাড়িসহ সব ধরণের যানবাহন চলছে। তখন ঝুঁকি নিয়ে ব্রেক করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত তিন বছরে সারাদেশে লেভেল ক্রসিংগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটেছে মোট ৮৩৭টি। বাংলাদেশে ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে অকার্যকর সিগন্যাল ব্যবস্থা, লেভেল ক্রসিংয়ের অব্যবস্থা এবং চালকের সিগন্যাল অমান্য করাকে দায়ী করা হয়েছে। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, গেইটম্যান লেভেল ক্রসিংয়ের গেইট বন্ধ না করার কারণে রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষ বাধে। এসব দুর্ঘটনায় অনেক যাত্রী হতাহত হন। অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করেন। এসব দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে লেভেল ক্রসিংগুলোকে সুরক্ষিত করতেই হবে। একই সাথ্যে অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাস্তবতা বিবেচনা করে এগুলো রাখা বা বন্ধ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তা দ্রুত কার্যকর করতে হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন