শফিউল আলম : প্রধান বন্দর ও শিল্প-কারখানার সূতিকাগার চট্টগ্রামে কল-কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠানে এখন চলছে দুর্দিন। দুর্দশায় ধুঁকছে বড়-ছোট-মাঝারি অন্তত একশ’ শিল্প-কারখানা। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা রুগ্ন হয়ে পড়েছে। এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাগজকল খ্যাত চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত কর্ণফুলী পেপার মিলস (কেপিএম), বন্দরনগরীর অনতিদূরে কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে রাঙ্গাদিয়ায় চিটাগাং ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) এখন শুধুই নামকাওয়াস্তে টিকে আছে। কর্ণফুলী রেয়ন মিলস (কেআরসি) আগেই রুগ্ন ও বন্ধ হয়ে গেছে। বৃহদায়তন ও রাষ্ট্রায়ত্ত এই তিনটি শিল্প-কারখানার অতি মূল্যবান স্টিলস সামগ্রী, ক্যাবল, যন্ত্রাংশ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত চুরি ও লোপাট হয়ে যাচ্ছে সংঘবদ্ধ অসৎ শ্রমিক-কর্মচারী ও দুর্বৃত্তচক্রের মাধ্যমে। আবার চলমান গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণেও অনেক শিল্প, কল-কারখানা নিরবচ্ছিন্ন সচল রাখা কিংবা চালু করা যাচ্ছে না। সেই সাথে চরম অব্যবস্থাপনা, অবহেলা, অনিয়ম-দুর্নীতি এবং সরকারি সুষম নীতির অভাবে শিল্প-কারখানা মার খাচ্ছে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিল্পখাতের দুর্দশায় দেশজ শিল্পের উৎপাদনের চাকা থমকে গেছে। স্থবিরতা নেমে এসেছে কর্মসংস্থানের পথে। অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে দেশি আর বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। অথচ চট্টগ্রামকেই সবসময় বলা হয় শিল্পায়ন ও বিনিয়োগের আদর্শ স্থান।
দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম শিল্প-প্রধান অঞ্চল হিসেবে ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই গড়ে উঠেছে। ঐতিহ্যের ধারক ও সর্ববৃহৎ শিল্প-কারখানাসমূহের অবস্থান চট্টগ্রামে। তবে বন্দর নগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে শিল্প প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানার আগের সেই সুদিন আজ আর নেই। একে একে শিল্প-কারখানা রুগ্ন ও অসাড় হয়ে পড়ছে। অনেক কল-কারখানা রুগ্ন হওয়ার পথে। ক্রমাগত গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট, শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য শিল্প-প্লট তথা স্থান সংকুলানের অভাব, হরেক পণ্যের অবাধ চোরাচালান, স্থানীয় শিল্পে উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়া, অবকাঠামো সমস্যা ইত্যাদি চট্টগ্রামে বিনিয়োগ ও শিল্পায়নে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে করে চট্টগ্রামে নতুন শিল্প, কল-কারখানা গড়ে উঠছে না। পুরনো অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানও অচলাবস্থার মুখে গিয়ে ঠেকেছে।
মূলত চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে ঘিরেই এ অঞ্চলে শিল্প-কারখানা বিকাশ লাভ করেছে। এককালে দেশের বনেদী শিল্পপতিরা প্রত্যেকেই এক বা একাধিক শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন চট্টগ্রাম থেকেই। দেশের প্রথম ও প্রধান রফতানি শিল্প প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল বা ইপিজেড এবং সেই সাথে বেপজার জন্ম চট্টগ্রামেই। এর আগে অসংখ্য বৃহদায়তন শিল্প, কল-কারখানা স্থাপিত হয় এ অঞ্চলে। এরমধ্যে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের ভারী শিল্প-কারখানা, কার্পেট মিল, বস্ত্র ও সূতার মিল, রেয়ন মিল, কাগজ কল, সার ও রাসায়নিক খাত, চামড়া, শিপব্রেকিং, স্টিল ও আয়রন শিল্প, জ্বালানি তেল পরিশোধন, গ্যাস প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, কাচশিল্প, জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত শিল্প, চা শিল্প হচ্ছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিল্পখাত।
চট্টগ্রামে শিল্প প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানার সেই সোনালি ঐতিহ্য আর টিকে নেই। শত শত ট্রাক কাভার্ড ভ্যান কাঁচামাল এবং উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী পরিবহনের জন্য কারখানার সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে না। চাটগাঁর বনেদী শিল্পপতির সংখ্যা কমে গেছে। অনেকেই রাজধানী ঢাকামুখী হয়ে গেছেন কিংবা ঢাকায় স্থায়ীভাবে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে গেছেন। বসবাস করছেন ঢাকায়। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ কিংবা খাতুনগঞ্জে আগের হেড অফিস সংকুচিত করে একটি লিয়াজোঁ অফিস চালিয়ে যাচ্ছেন কোনোমতে। বৃহৎ শিল্পের সংখ্যা আরও হ্রাস পেয়েছে। পাহাড়তলী, সীতাকু-, নাসিরাবাদ, কালুরঘাটসহ অনেক জায়গায় রুগ্ন ও অচল শিল্প-কারখানা কোথাও কোথাও বিভিন্ন মালামালের গুদাম ও আড়ত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার কারখানার জায়গায় ফ্ল্যাট, এপার্টমেন্ট গড়ে উঠতেও দেখা যাচ্ছে। অনেক কল-কারখানা উৎপাদন খরচের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অচল হয়ে পড়ছে। শিল্পপতিরা ভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। বড় বড় শিল্পাঞ্চলের অনেকাংশজুড়ে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা।
এ কে খান শিল্পগোষ্ঠী, ইস্পাহানি শিল্পগোষ্ঠীর মতো শীর্ষস্থানীয় আর কোনো শিল্প পরিবারের উত্থান নেই চট্টগ্রামে। ঐতিহ্যবাহী এসব শিল্পপতি পরিবার ব্যবসা-বাণিজ্যের লাভালাভের ঊর্ধ্বে উঠে চট্টগ্রামের উন্নয়নে ও সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই নিজেদের উদ্যোগে যথেষ্ট অবদান রাখেন। জনহিতকর কর্মকা-, খেলাধূলা ও সামাজিক কাজেকর্মে তাদের অবদান অবিস্মরণীয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্যটন শিল্পখাত বিকাশ লাভ করেছে প্রধানত বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাত ধরেই। ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা বলতে আজকাল মূলত গার্মেন্টস খাত এবং নিত্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানির ‘ট্রেডিং’ ব্যবসাকেই বোঝানো হয়। মৌলিক শিল্প খাত অবহেলিত থেকেই যাচ্ছে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিনদিকেই স্থলপথে ও নৌপথে চোরাচালানের পথ উন্মুক্ত। ভারত, মায়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড থেকে চোরাপথে কাপড়, জুতো-স্যান্ডেল, ছাতা, আচার, ব্যাগ থেকে শুরু করে হরেক রকম ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স ও ভোগ্যপণ্য, গৃহস্থালী পণ্যসামগ্রী বাজারে হু হু করে ঢুকে পড়ছে। তাছাড়া বাজারে সবরকম নিত্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়ে আসছে। অবাধ আমদানি ও চোরাচালানের পণ্যের সাথে দেশীয় শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। কেননা উৎপাদন খরচ আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রামে কল-কারখানা রুগ্নদশায় ধাবিত হচ্ছে।
এদিকে বৃহত্তর চট্টগ্রামে শিল্প, কল-কারখানা স্থাপনের জন্য স্থান সংকট এখন সবচেয়ে প্রকট। দেশের সর্ববৃহৎ চট্টগ্রাম ইপিজেডে নতুন করে শিল্প স্থাপনের জন্য খালি জায়গা নেই। কর্ণফুলী ইপিজেডেও একই অবস্থা। নগরীতে কিংবা শহরতলীতে শিল্পের জন্য খালি জায়গা মিলছেই না। নতুন বিনিয়োগ ও শিল্প স্থাপনে এটি সবচেয়ে বড় বাধা। চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সময়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং স্থানীয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের একক কিংবা যৌথ বিনিয়োগ ও শিল্প স্থাপন হয়নি। তবে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তোদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে মিরসরাই ও আনোয়ারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। উভয় অর্থনৈতিক জোন সম্পন্ন হলে চট্টগ্রামে শিল্প প্লটের অভাব ঘুচবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে শিল্প প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা সচল রাখা এবং প্রসারের পথে দীর্ঘদিনের প্রতিবন্ধক বিদ্যুৎ ও গ্যাসের তীব্র সংকট। উভয়মুখী সংকটের কারণে শিল্পায়নের পথ রুদ্ধ হয়ে আছে। চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরেই শিল্প-কারখানায় গ্যাসের নতুন সংযোগ প্রদান বন্ধ রাখা হয়। সম্প্রতি ফের চালু করা হলেও তা খুবই সীমিত। বর্তমানে চট্টগ্রামে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ন্যূনতম ৪শ’৮০ থেকে ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু এই চাহিদার বিপরীতে চট্টগ্রামে গ্যাসের সরবরাহ মিলছে গড়ে মাত্র ২৬০ থেকে সর্বোচ্চ ২৯০ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের চাহিদার প্রায় অর্ধেকই অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে বন্দরনগরীসহ চট্টগ্রামে বিদ্যুতের ন্যুনতম চাহিদা পিক আওয়ারে ৭শ’ মেগাওয়াট। সে ক্ষেত্রে এখন বিদ্যুৎ মিলছে গড়ে ৫শ’ মেগাওয়াট। গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটে চট্টগ্রামের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো মারাত্মক দুঃসময় অতিক্রম করছে। একটানা উৎপাদনের চাকা সচল রাখতে পারছে না কোন শিল্প-কারখানা। সার, তৈরি পোশাক, স্টিল ও আয়রন, হিমায়িত খাদ্য, বস্ত্র, কাচশিল্প, সিএনজি স্টেশনসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকট নিরসনের জন্য সরকারের কাছে ঘন ঘন তাগাদা দিয়ে আসছেন। কিন্তু স্থায়ী সুরাহা বেরিয়ে আসছে না। ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, বিদ্যুতের ঘাটতি এবং পর্যাপ্ত গ্যাস প্রাপ্তি ও সংযোগের অভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চলের রফতানিমুখী তৈরিপোশাক শিল্পখাত, সিএনজি ফিলিং স্টেশন, আবাসন, স্টীল ও রি-রোলিং মিলসমূহে উৎপাদনে সংকট বিরাজ করছে। এতে করে এসব খাতের উদ্যোক্তারা শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়ে সংকটে পড়েছেন। মূলধনী যন্ত্রপাতি বিনষ্ট, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান হ্রাস এবং উচ্চহারের ব্যাংক ঋণের কারণে হতাশাগ্রস্ত ও বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর সংলগ্ন কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে দেয়াং পাহাড়ের কোলে কোরীয় প্রতিষ্ঠান ইয়াংওয়ান কর্পোরেশনের বিনিয়োগে স্থাপন করা হয়েছে কোরিয়ান ইপিজেড (কেইপিজেড)। ইতোমধ্যে সেখানে এ যাবত শতভাগ রফতানিমুখী মাত্র দু’টি শিল্প-কারখানা চালু হয়েছে। কেইপিজেডের মোট ভূমির আয়তন ২৫ হাজার ৮৪ একর। কিন্তু শুধুই ভূমি মিউটেশন (নামজারি) কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় দীর্ঘ ১৫ বছর যাবত বিশেষায়িত এই শিল্পাঞ্চলের অপার সম্ভাবনার দুয়ার রুদ্ধ হয়েই আছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন