শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ভোগ্যপণ্য আমদানি : আড়ালে অর্থপাচার

প্রকাশের সময় : ২ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

তাকী মোহাম্মদ জোবয়ের : নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির আড়ালে অর্থপাচার করছে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে (বেশি মূল্য দেখিয়ে) পণ্য আমদানি করে অর্থ পাচার করছেন তারা। কাক্সিক্ষত অর্থপাচার হয়ে গেলে ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ না করেই লোকসান দেখিয়ে আমদানি ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন। অনেকে দেশ থেকেও চলে যাচ্ছেন। এতে বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলো হারাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে আমদানি করে কম দামে বিক্রি করছেন এসব ব্যবসায়ী। এতে এলসিতে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলো পুরো অর্থ ফেরত পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো আবার এসব ব্যবসায়ীদের এলসি খুলে দিচ্ছে। এভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়ে গেলে লোকসানের কারণ দেখিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন এসব আমদানিকারকরা। অভিযোগ রয়েছে, এই প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচারের সঙ্গে ব্যাংক ও শুল্ক বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রামের ৬টি গ্রুপই অর্থ পাচার করেছে ৬ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে নুরজাহান গ্রুপ ২ হাজার কোটি টাকা, মোস্তফা গ্রুপ ১ হাজার ২শ’ কোটি টাকা, মেসার্স সিদ্দিক ট্রেডার্স ১ হাজার কোটি টাকা, মেসার্স ইলিয়াস ব্রাদার্স ৮০১ কোটি টাকা, ইমাম গ্রুপ ৭শ’ কোটি টাকা ও ইয়াসির এন্টারপ্রাইজ পাচার করেছে ৪৮১ কোটি টাকা। লোকসানের কারণ দেখিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের শীর্ষ ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকরা গত কয়েক বছরে লোকসানের সম্মুখিন হননি।
দীর্ঘ দিন ছাতা’র ব্যবসা করলেও ২০০৯ সাল থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানি শুরু করে মেসার্স সিদ্দিক ট্রেডার্স। শুরুতেই বিপুল পরিমাণ গম, চিনি ও ছোলা আমদানি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বেশি দামে পণ্য এনে দেশে কম দামে বিক্রি করায় ব্যাহত লোকসানে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। অর্থায়নকারী কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ না করেই ব্যবসা গুটিয়ে নেয় সিদ্দিক ট্রেডার্স।
২০০৯ সাল থেকে খাতুনগঞ্জের ট্রেডিং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইয়াসির এন্টারপ্রাইজ বড় আকারে ভোগ্যপণ্য আমদানি শুরু করে। ব্যাংকের দায় না মিটিয়েই প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোহাম্মদ মোজাহের হোসেন আত্মগোপনে চলে যান। এই প্রতিষ্ঠানের কাছে রূপালী, ন্যাশনাল ও যমুনা ব্যাংকের পাওনা ৪৮১ কোটি টাকা। এছাড়া খাতুনগঞ্জের কয়েকজন ব্যবসায়ী তার কাছে পাবে ১২০ কোটি টাকার বেশি অর্থ। অর্থ পাচার করে এই ব্যবসায়ী বর্তমানে কানাডায় রয়েছেন বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের এক সময়ের শীর্ষ আমদানিকারক নূরজাহান গ্রুপ। ভোজ্যতেল, চিনি, মসলা ও ডালজাতীয় পণ্যের শীর্ষ আমদানিকারক ছিল প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘদিন ব্যবসা করে প্রচুর মুনাফা করে আসলেও হঠাৎ লোকসানের অযুহাত দিয়ে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয় গ্রুপটি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক ঋণের ২ হাজার কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়। এই অর্থের অর্ধেকও ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই ব্যাংকগুলোর। লোকসানের আড়ালে এই ২ হাজার কোটি টাকা নূরজাহান গ্রুপ পাচার করেছে বলে জানা গেছে। আবার এই টাকার একটি অংশ গেছে জমি ক্রয়ে।
একই পথে হেটেছে চট্টগ্রামের অন্যতম পুরনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইলিয়াস ব্রাদার্স। ২০১০ সালে হঠাৎ লোকসানের অযুহাত তুলে আমদানি ব্যবসা বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ততদিনে গ্রুপটির কাছে ব্যংকের পাওনা ৯১৫ কোটি টাকা যার মধ্যে ৮০১ কোটি টাকা ইতোমধ্যে খেলাপি। ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এই অর্থ পাচার হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ঐতিহ্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন ব্যবসা করে আসছিল মোস্তফা গ্রুপ। এই প্রতিষ্ঠানটির মালিকদের মাথায়ও হঠাৎ অর্থ পাচারের ভূত চাপে। বছরের পর বছর ব্যবসায়ে মুনাফা করলেও হঠাৎ অযুহাত তোলে লোকসানের। বন্ধ করে দেয় আমদানি ব্যবসা। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়ায় ১ হাজার ২শ’ কোটি টাকা যা অনেক আগেই খেলাপি হয়েছে। এই অর্থও পাচার হয়েছে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। আর ওভার ইনভয়েসিংয়ের কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠান লোকসানীতে পরিণত হবে।
একই প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের ৭শ’ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পাচার করেছে ইমাম গ্রুপ।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো ভোগ্যপণ্য আমদানিতে লোকসানের কথা বললেও মুনাফার সঙ্গে বড় পরিসরে আমদানি ব্যবসা করে যাচ্ছে আবুল খায়ের, পিএইচপি, টি কে, বিএসএম, সিটি, মেঘনা, ইফাদ, পারটেক্স, আবদুল মোনেম ও আমান গ্রুপ। বৃহৎ পরিসরে নতুনভাবে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় নাম লিখিয়েছে বিসমিল্লাহ গ্রুপ, মীর গ্রুপ, সালমা গ্রুপ, জামান এন্টারপ্রাইজ, আহাদ ট্রেডিং, এমজি, এমএইচ গ্রুপ, এসএ ট্রেডিংসহ বেশ কয়েকটি উদীয়মান ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এই খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভোগ্যপণ্য আমদানি লাভজনক না হলে অবশ্যই এই কোম্পানিগুলো এত বিপুল অর্থ আমদানি বাণিজ্যে বিনিয়োগ করতো না।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, দেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে তার ৮০ ভাগই হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে। এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে কারা কিভাবে অর্থ পাচার করছে তা এনবিআরের একাধিক শাখা তদন্ত করছে। আমাদের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৮০ ভাগ পাচারই হচ্ছে বাণিজ্যের নামে। অসাধু ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানির আড়ালে এ অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন