শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ মহররম ও আশুরা

সাইয়েদ আল আমিন | প্রকাশের সময় : ১৩ আগস্ট, ২০২১, ১২:০১ এএম

পবিত্র মাস মহররম। মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত, মর্যাদাপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ। এ মাসের মর্যাদা ও গুরুত্ব মুসলিমদের নিকট অপরিসীম। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা এবং প্রেক্ষাপট এর মহত্তে¡র প্রতি নির্দেশ করে। এর সাথে জুড়ে আছে পূর্ববর্তীদের প্রতি মহান আল্লাহ প্রদত্ত রহমত ও ক্ষমার বাণী। সেই জুড়ে আছে শোকগাথা কারবালা ট্রাজেডি। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এর পবিত্রতা ও মর্যাদার ঘোষণা দিয়ে ঐশি গ্রন্থ আল কুরআনে এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আসমান সমূহ ও যমিনের সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে গণনায় মাস বারটি, তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। কাজেই এই মাসগুলোতে তোমরা ( ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করে) নিজেদের প্রতি যুলুম করো না। ( সূরা আত তাওবাহ : ৩৬)।
বারটি মাস দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জুমাদাল আউয়াল, জুমাদাস সানি, রজব, শাবান, রমাদান, শাওয়াল, যিলক্বদ ও যিলহজ। আর চারটি সম্মানিত মাস দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, মহররম, রজব, যিলক্বদ ও যিলহজ। উক্ত আয়াতে আরবাআতুন হুরুম বা চারটি সম্মানিত মাস দ্বারা উদ্দেশ্য মহররম, রজব, জিলক্বদ ও জিলহজ এ ব্যাপারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসের বর্ণনা পাওয়া যায়। আবু বাকরাহ রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই সময় আবার ঘুরে তার নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ফিরে এসেছে। যে পদ্ধতিতে আল্লাহ তায়ালা আসমান ও যমিন সৃষ্টি করেছেন সেদিনের মত। মাসের সংখ্যা বারটি। তারমধ্যে চারটি হচ্ছে হারাম বা সম্মানিত মাস। তিনটি পরপর যিলক্বদ, যিলহজ ও মহররম। আর হচ্ছে মুদার গোত্রের রজব মাস, যা যুমাদাস সানি ও শাবান মাসের মাঝখানে থাকে। (সহিহ বুখারি: ৪৬৬২, সহিহ মুসলিম: ১৬৭৯)।
সম্মানিত মাস বলার প্রেক্ষিতে ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহুর বক্তব্য হচ্ছে, আল্লাহ পাকের এই উক্তির (হারাম মাস) মর্মার্থ হলো, তোমরা সকল মাসে সবধরনের পাপকাজ থেকে বিরত থাকবে, বিশেষকরে এই চার মাসে। কেননা, এগুলো বড়ই মর্যাদা সম্পন্ন মাস। এ মাসগুলোতে পাপ শাস্তির দিক দিয়ে এবং পূণ্য বা সওয়াব প্রাপ্তির দিক থেকে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। হযরত কাতাদা রহিমাহুল্লাহ বলেন, এ মাসগুলোতে পাপের শাস্তির বোঝা বেড়ে যায়, যদিও অত্যাচার সর্বাবস্থাতেই মন্দ। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার যে কাজকে ইচ্ছে বড় করে দেখেন। তিনি আরো বলেন যে, মহান আল্লাহ স্বীয় সৃষ্টির মধ্য থেকে বাছাই ও মনোনীত করেছেন। তিনি ফেরেশতাদের মধ্য থেকে দূত মনোনীত করেছেন। মানব জাতির মধ্য থেকে রাসূলদের মনোনীত করেছেন। কালামের মধ্য থেকে তার যিকিরকে পছন্দ করেছেন। যমিনের মধ্য থেকে মসজিদ সমূহকে পছন্দ করেছেন। মাসগুলোর মধ্য থেকে রমাদান ও হারাম মাসগুলোকে মনোনীত করেছেন। দিনগুলোর মধ্য থেকে শুক্রবারকে মনোনীত করেছেন। রাতগুলোর মধ্য থেকে লাইলাতুল কদরকে মনোনীত করেছেন। এভাবে মহান আল্লাহ যেটাকে চেয়েছেন প্রাধান্য দিয়েছেন। সুতরাং, আল্লাহ তায়ালা যেগুলোকে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা দিয়েছেন সেগুলোর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি লক্ষ্য রাখা আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য।
মহত্ত¡ ও মর্যাদায় পরিপূর্ণ আশুরাহ: মহররম মাস মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে আশুরা। এ মাসের দশম তারিখকে আশুরা বলা হয়। পৃথিবী সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে এই পবিত্র মাস মহররমের দশম তারিখ বা আশুরা। ইসলাম ও মুসলিমদের আন্তরিক ভালবাসা ও শোকের সাথে জড়িয়ে রয়েছে এই স্মৃতিবিজড়িত মহররমের আশুরা।
১০ই মহররম ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনা গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ক. পৃথিবী, আসমান-যমিন সৃষ্টি। খ. আদম আ.কে সৃষ্টি এবং নির্ধারিত কিছুদিন জান্নাতে বসবাসের পর পৃথিবীতে প্রেরণ। গ. পূনরায় পৃথিবীতে আদম আ. ও হাওয়া আ. সাক্ষাত। ঘ. মহাপ্লাবন শেষে নূহ আ. এর যুদি পাহাড়ে অবতরণ। ঙ. অত্যাচারী বাদশাহ নমরুদের অগ্নিকুন্ড থেকে হযরত ইব্রাহিম আ. এর মুক্তি লাভ। চ. নবী আইয়ুব আ. এর দীর্ঘ দুরারোগ্য রোগ থেকে মুক্তি লাভ। ছ. দীর্ঘ ৪০ বছরের বিচ্ছেদের পর বিদগ্ধ পিতা ইয়াকুব আ. ও পুত্র ইউসুফ আ. এর মাঝে সাক্ষাত ঘটে। জ. অত্যাচারী ফেরাউনের কবল থেকে বনী ইসরাইল জাতির মুক্তি ও ফেরাউনের ধ্বংস। ঝ. ঈসা আ. এর আসমানে গমন এবং দাজ্জালকে ধ্বংসের নিমিত্তে পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করবেন। ঞ. বেদনাদায়ক ট্রাজেডি কারবালা। নবী দৌহিত্র ও মুসলিম মিল্লাতের কলিজার টুকরো এবং জান্নাতি যুবকদের সর্দার হযরত হোসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর সপরিবারে শাহাদাত বরণ। এছাড়াও কেয়ামত সংঘটিত হওয়া সহ আরো অসংখ্য ঘটনার সম্মিলনের কথা হাদিসের বাণী ও ঐতিহাসিক উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়।
পবিত্র মাস মহররমে যুদ্ধবিগ্রহ ও অসংখ্য পাপকাজে যেমনি কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে তদ্রæপ এমাসে আমলের ফজিলতের ব্যাপারে এসেছে অসংখ্য সুসংবাদ। আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “রমদান মাসের রোযার পর সর্বোত্তম রোযা হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররামের রোযা । আর ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হচ্ছে রাতের (তাহাজ্জুদের) নামায ।” (সহিহ মুসলিম:১১৬৩, রিয়াদুস সলেহিন: ১১৭৫)।
আশুরার দিনে সিয়াম পালন: আশুরার রোজা সকল নবীর সুন্নত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমনের পূর্বে এবং পরে আশুরায় রোজা রেখেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (সা.) মদিনায় এসে দেখতে পেলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। নবী (সা.) বললেন, এটি কী? তারা বলল, এটি একটি ভালো দিন। এ দিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাঈলকে তাদের শত্রæর কবল থেকে বাঁচিয়েছেন। তাই মুসা (আ.) রোজা পালন করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, মুসা (আ.)-কে অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার। অতঃপর তিনি রোজা রেখেছেন এবং সাওম রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৬৫)।
নাবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিনী আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, আশুরা দিবস এমন একটি দিবস ছিল, যে দিবসে জাহিলিয়া যুগে কুরাইশগণ রোজা রাখত। জাহিলিয়া যুগে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও সে দিবসে রোজা রাখতেন। অতঃপর রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদিনায় এলে পরে তিনি সেই রোজা রাখলেন এবং লোকদেরকেও সেই দিনের রোজা রাখতে হুকুম করলেন। অতঃপর যখন রমাদানের রোজা ফরয হল, উহাই ফরয হিসেবে রইল। আশুরা দিবসের রোজা ছেড়ে দেয়া হল। অতঃপর যে ইচ্ছা করত ঐ দিবসে রোজা রাখত, আর যে ইচ্ছা করত না সে তা ছেড়ে দিত। (বুখারি ২০০২, মুসলিম ১১২৫; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদিস নং ৬৪৯)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আশুরার দিনের সাওমের ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, তিনি পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৭৬)।
রোজা রাখার ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, ১০ তারিখের সাথে ৯ বা ১১ তারিখেও রোজা রাখা। কেননা যখন সাহাবিদের পক্ষ থেকে আরজ হলো, ইয়া রাসুলুল্লাহ এই দিনকে তো ইয়াহূদি স¤প্রদায় অনেক সম্মান করে এবং তারাও রোজা রাখে তখন নবীজী বললেন আগামী বছর থেকে আমরা ৯ ও ১০ তারিখে সিয়াম পালন করবো। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, তোমরা মহরমের নবম ও দশম দিবসে রোজা রাখ। (তিরমিজি ৭৫৫)। অন্য হাদিসে নবি করিম (স) বলেছেন, আমি যদি আগামী বছর পর্যন্ত জীবিত থাকি তাহলে মহরম মাসের নয় তারিখের রোজাও পালন করব। (সহিহ মুসলিম ১১৩৪)।
সবিশেষ, এ পবিত্র মাসকে শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস বলে সম্বোধন করা হয়েছে। মহররম মাস পৃথিবীর সূচনা থেকে অদ্যবদী আল্লাহর রহমতের অসংখ্য নিদর্শনে ভরপুর। মহান আল্লাহ আমাদের জন্য অফুরন্ত সুযোগ করে দিয়েছেন অনেক বেশি সওয়াব ও নেকি অর্জনের জন্য। তাই আমাদের উচিত একাগ্রচিত্তে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদাতের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেয়া। এ মাস দোয়া কবুলের মাস। ক্ষমার এ মাসে আমাদের ইসতেগফার ও ইবাদতের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে আমাদের ইসলামী জীবনকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করতে হবে। আশুরায় ইবাদাত বন্দেগির গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যেনো মহররম ও আশুরার মহত্ত¡ হৃদয়ে ধারণ করতে পারি। আমাদের বাস্তব জীবনে এর শিক্ষা লালন করে প্রকৃত ইসলামের পথে চলতে পারি। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে আমলের সাথে জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Md. Maksudur Rahman ১৩ আগস্ট, ২০২১, ১০:৫৮ এএম says : 0
চমতকার আলোচনা।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন