ভারতে অতি বৃষ্টিপাতের কারণে অবিরাম নামছে ঢলের পানি। উজানের ঢলের তোড়ের সাথে সাথে তিস্তায় গজলডোবা, পদ্মা নদীর উজানভাগে গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধসহ সব বাঁধ-ব্যারেজ খুলে পানি ছেড়ে দিয়েছে ভারত। নিজেদের বন্যামুক্ত রাখতে বাঁধগুলো খুলে দিয়ে ভারত পানি ছাড়ছে। উজানের পানি তীব্রবেগে গড়াচ্ছে ভাটিতে বাংলাদেশের দিকে। তাছাড়া সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে দেশের অভ্যন্তরেও হচ্ছে ভারী বর্ষণ। এরফলে প্রধান নদ-নদীসমূহে একযোগে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
গতকাল শনিবার বিকেল পর্যন্ত বন্যায় প্লাবিত হয়েছে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন জেলার নিম্নাঞ্চল। ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার নদ-নদী সংলগ্ন বৃহত্তর রংপুরের চরাঞ্চল এবং ভারতের ঢলে ফুঁসে উঠা সুরমা নদী সংলগ্ন সুনামগঞ্জ জেলায় বিল-হাওড়, বাড়িঘর, হাট-বাজার, রাস্তাঘাটসহ নিম্নাঞ্চলসমূহ। অনেক এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতির আভাস রয়েছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত বন্যার মুখে এবং বন্যা কবলিত হয়েছে অন্তত ৮টি জেলা। পদ্মার ভাটি হয়ে চাঁদপুর-ভোলা-নোয়াখালী মোহনা পর্যন্ত প্রচন্ড ঘূর্ণিস্রোতের সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্রে লঘুচাপের ঘনঘটা থাকায় ফের উত্তাল হয়ে পড়তে পারে উপক‚লভাগ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভ‚ঁইয়া জানান, গতকাল প্রধান নদ-নদীসমূহের ১০৯টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৭৮টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি ও ২৮টিতে হ্রাস পায়। দু’টি স্থানে পানি অপরিবর্তিত থাকে। গতকাল সকাল পর্যন্ত পদ্মা নদী ভাটিতে শরীয়তপুরে বিপদসীমার এক এবং সুরমা নদী সুনামগঞ্জে ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে বিকাল নাগাদ সুরমার পানি সুনামগঞ্জে কিছুটা কমলেও বিপদসীমার ৯ সে.মি. ঊর্ধ্বে রয়েছে। পদ্মা বিপদসীমার নিচে নেমেছে। গত শুক্রবার নদ-নদীর ৭৪টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৩০টিতে হ্রাস ও ৫টিতে অপরিবর্তিত ছিল। বৃহস্পতিবার ৫৮ স্থানে পানি বৃদ্ধি ও ৪৯টিতে হ্রাস পায়।
বর্তমানে প্রধান নদ-নদীর বেশিরভাগ পর্যবেক্ষণ স্টেশনে পানি বৃদ্ধির দিকে রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগ এবং বাপাউবো সূত্রে জানা গেছে, প্রধান নদ-নদীসমূহের অববাহিকায় উজান বা উৎসস্থল উত্তর-পূর্ব ভারত, বিহার ও মধ্য-ভারত, নেপাল এবং তিব্বতসহ চীনে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। উজান থেকে ভাটিতে নামছে ঢল। ভরা বর্ষায় মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকায় দেশের অভ্যন্তরে নদ-নদী এলাকাসমূহে ভারী বর্ষণ হচ্ছে।
এ অবস্থায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল থেকে পদ্মা-মেঘনার ভাটি হয়ে চাঁদপুর-বৃহত্তর নোয়াখালী মোহনা পর্যন্ত প্রধান নদ-নদীগুলো এবং এরসঙ্গে যুক্ত শাখানদী, উপনদী, খাল-খাঁড়ি পর্যন্ত উত্তাল হয়ে উঠেছে। এতে করে উত্তরাঞ্চল থেকে মধ্যাঞ্চল হয়ে ভাটি-মোহনা অবধি নদীভাঙন ভয়াল রূপ ধারণ করেছে। দিশেহারা হয়ে পড়েছে নদীপাড়ের অসংখ্য মানুষ। বসতঘর, রাস্তাঘাট, বাঁধ, ফল-ফসলের জমি ভেঙে বিলীন হচ্ছে প্রমত্তা নদীগর্ভে। বানের পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে নদীভাঙন আতঙ্ক দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নদ-নদী পরিস্থিতি ও পূর্বাভাস
দেশের প্রধান নদ-নদীসমূহের প্রবাহ পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে পাউবো গতকাল জানায়, দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় তিস্তা, ধরলাসহ উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য সীমান্ত নদীগুলোর পানির সমতল দ্রæত বৃদ্ধি পেতে পারে। কতিপয় স্থানে স্বল্পমেয়াদি আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। আগামী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় পদ্মা নদী গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় শরীয়তপুর ও চাঁদপুর জেলার ন্নিাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে।
নদ-নদী প্রবাহ
গতকাল বিকাল পর্যন্ত পাউবোর সর্বশেষ নদ-নদী প্রবাহের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, উত্তর জনপদে তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার মাত্র ৪ সে.মি. নিচে এবং কাউনিয়ায় ৪৩ সে.মি. নিচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা নদীর পানি আরও বেড়ে গিয়ে কুড়িগ্রামে বিপদসীমার ৬৭ সে.মি. নিচে রয়েছে।
গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। মোট ৮টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে পদ্মার উজানভাগে পাংখায় ৭৬ এবং ভাটির দিকে গোয়ালন্দে ২৫ সে.মি. নীচে এসে গেছে। উজানে গঙ্গায় ভারতের ফারাক্কা বাঁধের অধিকাংশ গেইট (স্পিলওয়ে) খুলে দেয়া হলে পরিস্থিতি অবনতির দিকে মোড় নেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আপার মেঘনা অববাহিকায় অধিকাংশ স্থানে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এরমধ্যে গতকাল বিকাল পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি আরও বেড়ে গিয়ে কানাইঘাটে বিপদসীমা ছুঁইছুঁই (মাত্র ৩ সে.মি. নিচে), সিলেটে ৬৭ সে.মি. নিচে এবং সুনামগঞ্জে ৯ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়। সারিগোয়াইন নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সারিঘাটে বিপদসীমার ১৯ সে.মি. নিচে অবস্থান করছে। সোমেশ^রী নদীর পানি কলমাকান্দায় ২৯ সে.মি. নিচে রয়েছে।
গতকাল ২৪ ঘণ্টায় প্রধান নদ-নদীসমূহের উজানের অববাহিকায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে, চেরাপুঞ্জিতে ১৯২, পাসিঘাটে ৮৫, জলপাইগুড়িতে ৪৩ মিলিমিটার। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে লালাখালে ১৯০, পঞ্চগড়ে ১২৪, নারায়ণহাটে ৮৩, টাঙ্গাইলে ৮০, ছাতকে ৭৫, বরগুনায় ৭৩, জাফলংয়ে ৬৭, দুর্গাপুরে ৬৬, লরেরগড়ে ৬৫, নাকুয়াগাঁওয়ে ৬১, রামগড়ে ৫৪, সিলেটে ৫২ মি.মি. ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে পাউবো।
রংপুর থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নীলফামারী জেলার জলঢাকা, ডিমলা, লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম, কালিগঞ্জ, হাতিবান্ধা, আদিতমারী উপজেলা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে।
ইতিমধ্যে লালমনিরহাট জেলার পাট গ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, সিঙ্গামারি, সিন্দুর্না, ডাউয়াবাড়ী, পাটিকাপাড়া, কালীগঞ্জ উপজেলার ডাউয়াবাড়ী, নোহালী, ভোটমারী ও চর বৈরাতি, আদিতমারী উপজেলার পলাশী ও মহিষখোচা, সদর উপজেলার রাজপুর, খুনিয়াগাছ, গোকুন্ড ইউনিয়নের তিস্তাবাজারসহ নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে।
এছাড়াও নীলফামারী উপজেলার ডিমলা উপজেলার ঝাড় শিঙ্গেশ্বর, কিছামত ছাতনাই, পূর্ব খড়িবাড়ি, পশ্চিম খড়িবাড়ি, চর খড়িবাড়ি, তিস্তা বাজার, তেলির বাজার, ঝুনাগাছ, বাইশ পুকুর, ভেন্ডাবাড়ি, চাঁপানীর ছাতুনামা কেল্লাপাড়া, জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী, রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘন্টা, হাবু, ছোট রুপাই, বড়াইবাড়ি, নোহালী, কচুয়া, লক্ষীটারী ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলি, শঙ্করদহ, বাগেরহাট আশ্রয়নসহ আরো বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, গত ২৪ ঘন্টায় সুনামগঞ্জের লাউড়েরগর এলাকায় ৬৫ মিলিমিটার ও দুর্লভপুর পয়েন্টে ১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাওরসহ নদ-নদীতে বাড়ছে পানি। এ বৃষ্টিপাত আগামী ৪৮ ঘন্টা অব্যাহত থাকতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন