হাসান সোহেল : বর্তমান সরকারের নেয়া মেগা প্রকল্পগুলোতে রিজার্ভের অর্থ ব্যবহারের চিন্তা-ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এতে একদিকে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়ন নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না। ফলে দ্রুত শেষ করা সম্ভব হবে এসব বড় উন্নয়ন প্রকল্প। অন্যদিকে, রিজার্ভের অর্থ আর অলস পড়ে থাকবে না। মুনাফাসহ এসব অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোষাগারে ফিরে আসায় রিজার্ভ আরো স্ফীত হবে। তবে কিভাবে রিজার্ভ থেকে সরকার ঋণ নেবে, কিভাবে সুদ ও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবেÑ এসব বিষয়ে আগেই একটি নীতিমালা তৈরি করে নিতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৩ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোষাগারে থাকা এই বিদেশী মুদ্রার অংক দিন দিন বড় হচ্ছে। আর তাই এখান থেকে ঋণ নিয়ে তা মেগা প্রকল্পে খাটানোর কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকও এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছে। কিভাবে রিজার্ভের অর্থ সরকারকে ঋণ হিসেবে দেবে সে বিষয়ে গভর্নর কিছু প্রস্তাবও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রীকে।
সরকার মোট দশটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে, যেগুলোকে ‘মেগা প্রকল্প’ বলা হচ্ছে। এ প্রকল্পগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তদারকি করছেন। পদ্মা বহুমুখী সেতু, মেট্রোরেল, পায়রা সমুদ্রবন্দর, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে এসব প্রকল্পের মধ্যে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর ও এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্প ছাড়া সব ক’টিতেই আলাদা বরাদ্দ রেখেছেন অর্থমন্ত্রী।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, এটা একটি ভালো উদ্যোগ। কেননা বিশাল পরিমাণ অর্থ অলস পড়ে আছে এবং সরকার যদি উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নে এই অর্থ ব্যবহার করে, তাহলে ব্যয়বহুল বিদেশী সহায়তা নিতে হবে না। তিনি বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য দেশের বিনিয়োগ প্রয়োজন হয় এবং সরকার যদি রিজার্ভ থেকে এ ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহণ করে তাহলে সেটা অর্থনীতির জন্য ভালো হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদও রিজার্ভের অর্থ মেগা প্রকল্পে ব্যবহারের সমর্থন জানিয়েছেন। তবে এর জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করার কথা বলেছেন তিনি। ড. সালেহ উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, কিভাবে ঋণ নেয়া হবে, সুদের হার কত হবে, কয় বছরের জন্য নেয়া হবে, টাকায় ফেরত দেয়া হবে না ডলারে এবং কোনো ‘কিছু’ ঘটলে জবাব কে দেবেÑ এসব বিষয় চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একই সঙ্গে রিজার্ভের অর্থ মেগা প্রকল্পে দীর্ঘসময়ের জন্য ব্যবহার করলে সমস্যায় পড়তে হতে পারেÑ এসব বিষয় বিবেচনা করতে হবে। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রিজার্ভের অর্থ জনগণের। বিনিয়োগ বাড়ানো, আমদানি-রফতানি, কারেন্ট অ্যাকাউন্টসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহারই মূল উদ্দেশ্য। তাই বিনিয়োগ বাড়ানোই সবচেয়ে শ্রেয়। এরপরও প্রয়োজনে মেগা প্রকল্পে ব্যবহার করা যেতে পারে।
রিজার্ভের অর্থ মেগা প্রকল্পে ব্যবহারের চিন্তা করছেন জানিয়ে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমাদের রিজার্ভস আর সো হাই। হাউ টু ইউজ দিজ রিজার্ভÑ এটা নিয়ে আমরা একটু চিন্তাভাবনা করছি। বাংলাদেশ ব্যাংকও কিছু আইডিয়া দিয়েছে।’ এ বিষয়ে নিজের ‘আইডিয়া’ প্রকাশ করে মুহিত বলেন, ‘ওখান (রিজার্ভ) থেকে আই ক্যান টেইক লোন। ফর মেগা প্রজেক্টস, ফর বিগ প্রজেক্টস। মেগা প্রজেক্টে লোন বেশি, সেটা একটা হতে পারে। সেটার মেকানিজম বের করতে হবে।’
নিজস্ব সম্পদ কিভাবে আরও ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে সব সময় ভাবনায় থাকেন জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘উই শুড মেইক ইউজ অব দিজ রিসোর্সেস দ্যাট উই হ্যাভ। এর মধ্যে রিজার্ভ একটা, হিউজ রিজার্ভ, ইটস আ রিসোর্স। উই শুড ইউজ দ্যাট।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযাযী, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ৩১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ বিলিয়ন ডলার বেশি। প্রতি মাসে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসেবে এই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তৈরি পোশাকের রফতানি বৃদ্ধি এবং বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী নাগরিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের কারণে গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে রিজার্ভের পরিমাণ। এর আগেও একাধিকবার রিজার্ভের অর্থ পদ্মা সেতুতে ব্যবহারের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী।
মেগা প্রকল্পে রিজার্ভ ব্যবহারের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনও একটি নীতিমালা তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। তারা এটা সরকারকে ঋণ হিসেবে দেবে না বিক্রি করবে এটা নির্ধারণ করতে হবে। একই সঙ্গে ঝুঁকির অ্যালোকেশন নির্ধারণসহ পারিপার্শ্বিক অন্য বিষয়গুলোও নির্ধারণ করতে হবে।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মালয়েশিয়া ও চায়নার রিজার্ভ প্রচুর। তারা কিন্তু রিজার্ভ এভাবে ব্যবহার করেনি। চায়না, সউদী আরব, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশ রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার জন্য নিজেরাই পৃথক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। আবার বিশ্বব্যাংকসহ অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়েছে। তাই রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা একান্তই বাংলাদেশ ব্যাংকের বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবিদ। তবে বিশ্বের কোনো দেশে রিজার্ভের অর্থ মেগা প্রকল্পে বা সরকারি কাজে ব্যবহারের নজির আছে কি না তা জানা নেই বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবিদ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা একটি ভালো উদ্যোগ। তিনি বলেন, সরকার যদি বিনিয়োগের জন্য রিজার্ভ থেকে ঋণ নেয় তাহলে সেটা অর্থনীতির জন্য ভালো হবে। মুস্তাফিজুর রহমানও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহারের লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরুপাক্ষ পাল বর্তমান রিজার্ভের বিষয়ে বলেন, এটা হচ্ছে এরকমÑ কোনো রকম মেদ না কমিয়ে আমরা মোটা হচ্ছি। তিনি বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যথেষ্টÑ এর চেয়েও বেশি উল্লেখ করে বলেন, রিজার্ভের একটি অংশ যদি মেট্রোরেল নির্মাণের মতো বৃহদাকার প্রকল্পে ব্যয় হয়, তাহলে আমদানি বাড়বে। কেননা এর জন্য দেশে নির্মাণসামগ্রী আমদানি করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন