লাখো তৌহিদি জনতার অংশগ্রহণে হাটহাজারীতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ আলেম আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষাসচিব শায়খুল হাদিস আল্লামা হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরীর নামাজে জানাযা এবং দাফন সম্পন্ন হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ২৪ মিনিটে হাটহাজারী মাদরাসা ময়দানে স্মরণকালের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পওে রাত পৌনে ১২টায় তার দীর্ঘদিনের কমস্থল হাটহাজারী মাদরাসা কবরস্থানে আল্লামা শাহ আহমদ শফির কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। মুখে কালেমা শাহাদাত আর অশ্রুসজল চোখে অকুতোভয় মজলুম এ আলেমেদ্বীনকে চির বিদায় জানানো হয়।
তার মামা ও হেফাজতে ইসলামের উপদেষ্টা এবং সদ্য ঘোষিত আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী নামাজে জানাযায় ইমামতি করেন। এতে মানুষের ঢল নামে। হাটহাজারী মাদরাসা ময়দান ছাড়িয়ে মুসল্লির কাতার বিস্তৃত হয় আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকায়। দুপুরের পর থেকে জানাযায় অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ হাটহাজারীতে আসতে থাকে। বিকেলের মধ্যে পুরে এলাকা জনসমুদ্রে রূপ নেয়। চারি দিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। এলাকায় সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। জানাযার আগে স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বক্তব্য রাখেন।
বাবুনগরীর গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ির বাবুনগরে তাকে দাফন করার জন্য আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। সেখানে জানাযা এবং দাফনের প্রস্তুতিও ছিলো। তবে হেফাজতের শীর্ষ নেতা ও মাদসার শিক্ষকদের সিদ্ধান্তে তাকে হাটহাজারী মাদরাসায় দাফন করা হয় বলে রাতে জানান হেফাজত নেতা মীর ইদ্রিস।
বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর বেসরকারি সিএসসিআর হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ৬৮ বছর বয়সী এই মজলুম আলেমকে অ্যাম্বুলেন্সে হাটহাজারী থেকে নগরীর সিএসসিআর হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ কিডনী, ডায়বেটিকস, হাই-প্রেসারসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, পাঁচ কন্যা, এক পুত্র সন্তানসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেনে।
ঈমানী তেজদীপ্ত অকুতোভয় প্রখ্যাত এ আলেমেদ্বীনের ইন্তেকালের খবরে চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী শোকের ছায়া নেমে আসে। তাকে শেষবারের মতো দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে সর্বস্তরের আলেম-উলামা, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ তৌহিদি জনতা হাসপাতাল এবং হাটহাজারী মাদরাসায় ছুটে আসেন।
তাকে শেষ বিদায় জানাতে হেফাজতের নেতাকর্মী, সমর্থকদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও হাটহাজারী মাদরাসায় আসেন। তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল হাটহাজারী মাদরাসা এবং জন্মস্থান উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাবুনগরে নেমে আসে শোকের ছায়া।
প্রবীণ এ শিক্ষকের আকস্মিক ইন্তেকালের খবরে ছুটে আসা হেফাজতের সর্বস্তরের নেতাকর্মী, আলেম-উলামা, মাদরাসার শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজন কান্নায় ভেঙে পড়েন। সুশৃঙ্খলভাবে জানাযা দাফন সম্পন্ন করতে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত হাটহাজারী মাদরাসায় দফায় দফায় বৈঠকে মিলিত হন হেফাজত নেতা ও মাদরাসার শিক্ষকগণ। প্রথমে বাদ মাগরিব হাটহাজারী মাদরাসায় তার নামাজে জানাযা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হলেও পরে সারাদেশের আলেম-উলামাদের অনুরোধে সময় বাড়িয়ে রাত ১১টায় করা হয়।
দেশের সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক এবং তৌহিদি জনতার প্রাণপ্রিয় ঈমানী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমির ও প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ছিলেন তিনি। দেশে ইসলামী ভাবধারা, ঈমান-আকিদা সংরক্ষণ এবং ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে জীবন অতিবাহিত করেছেন মজলুম এ আলেম। নাস্তিক মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনের আপোসহীন ভূমিকার কারণে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিত আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী। ঈমান আকিদা রক্ষায় হেফাজতের ১৩ দফা দাবিতে ঐতিহাসিক লং মার্চ এবং পরবর্তিতে শাপলা চত্বরে ট্র্যাজেডিতে তিনি সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাবুনগরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বাবুনগরীর জন্ম হয়। তার পিতার নাম আবুল হাসান ও মাতা ফাতেমা খাতুন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি জমিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরে ভর্তি হন। সেখানে তিনি মক্তব, হেফজ ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯৭৬ সালে সেখান থেকে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশে তিনি পাকিস্তান যান। ১৯৭৬ সালে করাচিতে জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় তাখাচ্ছুছাত ফিল উলুমুল হাদিস তথা উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে ভর্তি হন। দুই বছর হাদিস নিয়ে গবেষণা শেষে তিনি আরবি ভাষায় সীরাতুল ইমামিদ দারিমী ওয়াত তারিখ বি শায়খিহী শীর্ষক অভিসন্দর্ভ জমা দেন। সেখান থেকে তিনি হাদিসের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে তিনি বাবুনগর মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। বাংলাদেশের মাদরাসাসমূহে সর্বপ্রথম বাবুনগর মাদরাসায় তিনি উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ চালু করেন। ২০০৩ সালে তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় যোগ দেন। সর্বশেষ তিনি এ মাদরাসার শায়খুল হাদিস এবং শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
অপরদিকে ২০১৩ সালে তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিবের দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর (রহ.) ইন্তেকালের পর ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বরের হেফাজত আমির পদে মনোনীত হন। এরপর চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল নানা কারণে ওই কমিটি ভেঙে দিয়ে তার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি গত ৭ জুন ৩৩ জনে উন্নীত হয়। ঈমান আকিদা রক্ষার আন্দোলনে অর্ধ শতাধিক মামলার আসামি হন প্রবীণ এ আলেমেদ্বীন আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন