শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বান বর্ষণ আশীর্বাদ বয়ে এনেছে বরেন্দ্র অঞ্চলে

প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রেজাউল করিম রাজু : উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি আর ভারি বর্ষণ রাজশাহী অঞ্চলের নদীর তীর মানুষকে ডুবিয়েছে, শংকায় ফেলেছে। আবার বিপরীতে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলে। বরাবরের মতো এবারো ওপারের বন্যার চাপ সামাল দিতে ফারাক্কার সবকটি গেট খুলে দিয়ে এপারে বিপুল পরিমাণ পানি ঠেলে দিয়ে ডুবিয়েছে। ভাঙনে বিলীন হয়েছে জনপদ ফসলের ক্ষেত। অন্যবারের চেয়ে এবারে পানির চাপটা পদ্মায় বেশি ছিল। কারণ ওপারের ভারতের বিহারসহ বিভিন্ন রাজ্যের ভয়াবহ বন্যা। পদ্মার পানি বিপদ সীমা ছুঁই ছুঁই করলেও তা অতিক্রম করেনি। তবে দাপট দেখিয়েছে সমানে। ভর যৌবন নিয়ে প্রবল বেগে দুপাড় ছাপিয়ে ছুটে তছনছ করে ছুটে ছিল। সাথে ছিল উপরের বর্ষণ। যা পরিস্থিতিকে আরো বিপর্যস্ত করেছে। কৃষি বিভাগের হিসাবে শুধুমাত্র পঞ্চাশ হাজার হেক্টর জমি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এদিকে বর্ষণ ও বন্যা আশীর্বাদ হয়েছে লাখ লাখ হেক্টর জমির কৃষি আবাদ আর মাছের জন্য। বরেন্দ্র অঞ্চলে বর্ষণ আবাদের উপকার বয়ে এনেছে। বিশেষ করে আমন আবাদে। ক’বছর ধরে যখন পানির কারণে আমন আবাদ বিঘিœত হচ্ছিল। সাধারণত বৃষ্টির পানি নির্ভর আবাদ আমন। কিন্তু পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় জমিতে জো আসেনি। বীজতলা পর্যন্ত করা যায়নি। শেষ মেষ বৃষ্টি নির্ভর ফসল আমন ব্যবহার করতে হয়েছে ভূ-গর্ভস্থ সেচের পানি। অবস্থা এমন দাড়ায় যে ইরি আমন সবটাই হয়ে পড়ে সেচ নির্ভর। ভূ-গর্ভস্থ পানি সেচ দিয়ে আমন আবাদ করতে গিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সে তুলনায় উৎপাদিত ফসলের নায্য দাম না পেয়ে লোকসানের মুখে পরে পরবর্তীতে আমন আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়েছে অনেকেই। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। বরেন্দ্র অঞ্চলের ফসলের ক্ষেতের সবুজতা বলে দিচ্ছে বাস্তবতা। ঝুপ ঝাপ বৃষ্টি আর রোদ্রের মধ্যে কৃষকের ব্যস্ততা। লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে আমনের ক্ষেত। উঁচু জমিতে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে শীতকালীন আগাম শাক-সবজির। নদী তীরবর্তী এলাকায় ক্ষেতগুলো বানের পানিতে হোঁচট খেলেও বরেন্দ্রের উঁচু ঢালু জমিতে তার প্রভাব নেই। বরং ফসলের ব্যাপকতা বন্যার ক্ষতি সার্বিকভাবে পুষিয়ে যাবার ইঙ্গিত বহন করছে। কৃষকের ভাষায় বৃষ্টি তাদের কাছে এসেছে আল্লাহর রহমত হিসাবে। আবহাওয়া দপ্তর এবার বর্ষা মওসুমে এ অঞ্চলে এখন পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে ১২৮৮.৩ মিলি মিটার। আর গত বছর ছিল ১৪২০ মিলিমিটার। কৃষি বিভাগ জানায়, এবার রাজশাহী অঞ্চলে আমন চাষের টার্গেট ছিল তিন লাখ বাহাত্তর হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে। আর আবাদ হয়েছে তিন লাখ ৯৫ হাজার হেক্টরের বেশী জমিতে। সব ঠিক ঠাক থাকলে চাল উৎপাদন হবে ৯১ লাখ মে: টন। রাজশাহী জেলাতে আবাদ বেড়েছে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে। আউশ আবাদের সরকারি প্রণোদনার টাকা যেমন প্রান্তিক চাষীর ভাগ্যে জুটেনি। তেমনি আমনেও। প্রান্তিক চাষীরা এখন আর ওসব নিয়ে ভাবে না। তাদের একটাই প্রত্যাশা ঘাম ঝরানো ফসলের ন্যায্য দাম। ঋণের অক্টোপাস থেমে মুক্তি। কৃষি বিভাগ আমনের ভালো আবাদ দেখে এখন হিসাব কষছে শীতকালীন শাক-সবজির আবাদ নিয়ে। ভারি বর্ষণ আর বানের পানি আশীর্বাদ বয়ে এনেছে মাছের আবাদেও। খাল বিল ডোবা নালা এখন কানায় কানায় ভরা। এবার প্রকৃতিক জলাশয় ও খাল বিলে মাছের আবাদ ভাল হবে। প্রত্যেক খাল বিলে ঢুকেছে মাছের পোনা। বিশেষ করে পদ্মা ও তার শাখা নদী দিয়ে বিভিন্ন খাল বিলে যে ঘোলা পানি গেছে তার সাথে ছিল নানা প্রজাতির মাছের রেণু আর পোনা। ধীরে ধীরে এগুলো বড় হচ্ছে। এবার খাল বিল হতে নানা প্রজাতির মাছ মিলবে বলে প্রত্যাশা এ বিষয়ে বিজ্ঞজনদের। তাছাড়া ভারি বর্ষণে পুকুর মাছের খামার ড্রেন নালা সব একাকার হয়ে যায়। পুকুর ও খামারের মাছও ভেসে মিলেমিশে গেছে। এবার সব জলাশয়ে নানা প্রজাতির প্রচুর মাছ পাওয়া যাবে। খালবিলে ঝাঁক ধরে ছোট ছোট মাছের পোনা ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে। গৃহস্থলি কৃষি আবাদ আর মাছের খামার সব ক্ষেত্রে নীচের পানি অবিরামভাবে তোলায় ভূ-গর্ভস্থ স্তর নেমেছে মারাত্মকভাবে। যে পরিমাণ পানি তোলা হচ্ছে তার সামান্য অংশ পুন:ভরণ হচ্ছে। পুন:ভরণের উপায় হলো নদীতে পানি আর ভারী বর্ষণ। কিন্তু নদী বেশিরভাগ সময় থাকছে শুকনো আর বর্ষণের পরিমাণও কমে গেছে। ফলে রিচার্জ হচ্ছে কম। বর্ষা মৌসুমে যে পানি নদীতে আসে আর বর্ষণ হয় তার বেশিরভাগ গড়িয়ে যায় সমুদ্রের দিকে। পুন:ভরণ হবার সুযোগ কম হয়। বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু ঢালু জমিতে। তাছাড়া এখানকার ভূ-প্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায় মাটির নিচের কর্দমস্তর অত্যন্ত কঠিন ও অপ্রবেশ্য। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। বরেন্দ্রের সত্তর হাজার পুকুরের মধ্যে অর্ধেক সরকারি খাস। যার সিংহভাগ হেজেমজে গেছে। অন্যের দখলে গেছে। আবার অনেক পুকুর ভরাট করে কৃষি জমি করা হয়েছে। বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ হাজার তিনেক পুকুর দিঘী পুন:খনন ও সংস্কার করেছে। যা ফের চলে গেছে প্রভাবশালী আর রাজনৈতিক লোকজনের হাতে। বরেন্দ্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত খাল খাড়ির সংখ্যা প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার। যার মধ্যে অর্ধেক খাড়ি সংস্কার করা হয়েছে। যাতে করে বৃষ্টির পানি গাড়িয়ে সরাসরি নদীতে না চলে যায়। সেজন্য ক্রসড্যামও করা হয়েছে। শুকনো মওসুমে সরমংলা খালে পদ্মা নদী থেকে পানি এনে ভরাট করা হয়। এসব খাল পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখছে। বিএমডিএ বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি ভূ-গর্ভের রিচার্জ বাড়ানোর জন্য খাড়ির নীচের অংশ সত্তর থেকে একশো কুড়ি ফুট পর্যন্ত গভীরতায় সাড়ে পাঁচশোটি কুয়া খনন করেছে। যার মাধ্যমে দ্রুত পানি যাতে নীচে চলে গিয়ে রিচার্জ হয়। বিএমডিএর সংশ্লিষ্ট সহকারী প্রকৌশলী জানান তিন বছর আগে খাড়ির মধ্যে কুয়া স্থাপন করে দেখা গেছে ভ’গর্ভস্থ পানির স্তর উপরে উঠছে। শুরুতে যেখানে পানির স্তর ছিল ৬৬ ফিট ১১ ইঞ্চি। চলতি বছরের মাপ অনুযায়ী রিচার্জ হয়ে স্তর হয়েছে ৬৬ ফুট ৩ ইঞ্চি। অথাৎ আট ইঞ্চি পানির স্তর উপরে উঠেছে। ডাসকো ফাউন্ডেশন নামে একটা বেসরকারী সংস্থা সুইস রেডক্রসের সহযোগিতায় বরেন্দ্র এলাকায় পানির রিচার্জ নিয়ে কাজ করছে। ভবনের ছাদের পড়া বৃষ্টি পানি সংগ্রহ করে ভ’গর্ভে পাইপের মাধ্যমে প্রেরন করার প্রকল্প শুরু করেছে। তাদের জরিপেও দেখা গেছে পানির স্তর নয় ইঞ্চি বেড়েছে। এ প্রকল্পে কারিগরি সহযোগিতা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ’-তত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও প্রোভিসি ড.চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল।
তিনি বলেন প্রকল্পটি শুরুর পর প্রাপ্ত ফল ভালই বলে মনে হচ্ছে। এটি শুধু একস্থানে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। যেখানে পানি সংকট প্রকট সেসব স্থানে কাজ করতে হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান এর বিস্তার ঘটাতে হলে সরকারসহ জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার যদি ভবন নির্মান কোড অনুযায়ী সকল বসত বাড়ি ও ভবন নক্সা করার সময় বাধ্য করার আইন প্রনয়ন করে তবে সকল ভবনের ছাদের বৃষ্টির পানি পাইপের মাধ্যমে মাটির নীচে পাঠানো যায়। তাহলে খুব দ্রুত পানির স্তর বাড়বে। বিশিষ্ট নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন উজানের ঢল আর বৃষ্টি পাতের কারনে পদ্মা মহানন্দায় যত পানি আসে তা সংরক্ষন করতে পারলে বদলে যাবে এ অঞ্চলের পরিবেশ জীব বৈচিত্র। এজন্য প্রয়োজন গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ পদ্মায় ক্যাপিট্যাল ড্রেজিং। মজে যাওয়া নদ নদীগুলো খননের মাধ্যমে আগের প্রবাহে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। সর্বোপরি ফারাক্কার পাষাণ গেটগুলো সব সময়ের জন্য উন্মুক্ত রেখে গঙ্গাকে তার স্বাভাবিক পথ চলতে দেয়া। এটা সময়ের দাবি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
masum ৪ অক্টোবর, ২০১৬, ৮:২৭ এএম says : 0
so nice.............................................................................................................
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন