প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি বেড়েই চলেছে। উত্তাল শাখা-প্রশাখা, উপনদী, মোহনা। উজানে ভারত থেকে ঢলের তোড় বৃদ্ধি পাচ্ছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে ঢল-বানের পানি গড়াচ্ছে ভাটিতে বাংলাদেশের দিকে। উজানে সব বাঁধ-ব্যারেজ খুলে ভারত পানি ছেড়ে দেয়ায় ঢল আরও তীব্র আকারে ধেয়ে আসছে। পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র ইতোমধ্যে প্রধান নদ-নদীসমূহের অববাহিকাভিত্তিক বন্যা পূর্বাভাস প্রতিবেদনে জানায়, আবহাওয়ার সাম্প্রতিক পূর্বাভাস ও প্রবণতা অনুযায়ী আগামী দুই সপ্তাহে উজানের নদ-নদী অববাহিকাসমূহের অনেক স্থানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
তাছাড়া মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে দেশের অভ্যন্তরেও নদ-নদী অববাহিকা এলাকায় মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। এতে করে একযোগে উত্তাল প্রধান নদ-নদী এবং এর সাথে যুক্ত শাখানদী, খালগুলো। বিপদসীমার ঊর্ধ্বে রয়েছে প্রধান নদ-নদীসমূহ। এরফলে দেশের অনেক জায়গায় বন্যার আরও অবনতি হচ্ছে। দিন দিন বিস্তার ঘটছে বন্যা ও নদীভাঙনের। পাউবো পূর্বাভাসে জানায়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তর জনপদের কুড়িগ্রাম, উত্তর-মধ্যাঞ্চলে সিরাজগঞ্জ, মধ্যাঞ্চলে টাঙ্গাইল, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও চাঁদপুর এই ৯টি জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
গতকাল শুক্রবার ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনাসহ আটটি নদ-নদী ১২টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ৬১টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক স্থানে পানি বেড়ে গিয়ে বিভিন্ন নদী বিপদসীমার কাছাকাছি রয়েছে। সেই সঙ্গে বিস্তৃত হচ্ছে নদীভাঙন। দেশের উত্তর, উত্তর-মধ্য, মধ্যাঞ্চল, উত্তর-পূর্ব থেকে ভাটিতে দক্ষিণে চাঁদপুর মোহনা, খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিম উপক‚ল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। নদীভাঙন বাড়ছে নতুন নতুন এলাকায়। বসতভিটা, আবাদি জমি, ক্ষেত-খামার, রাস্তাঘাট গ্রাস করছে প্রমত্তা নদী। বন্যার্ত ও নদীভাঙনের শিকার লাখো পানিবন্দি মানুষের নানামুখী দুর্ভোগ সীমাহীন।
দেশের প্রধান নদ-নদীসমূহের পরিস্থিতি সম্পর্কে পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, গতকাল বিকাল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, ধরলা, দুধকুমার, ধলেশ^রী, আত্রাই এই ৮টি নদ-নদী ১২টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
প্রধান নদীসমূহের ১০৯টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৬১টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৪২টিতে হ্রাস, ৬টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং ১২টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে রয়েছে। বৃহস্পতিবার নদ-নদীর ৭২টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৩৫টিতে হ্রাস, দু’টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং এরমধ্যে ১০টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল। বুধবার ৬৬টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৩৯টিতে হ্রাস, ৪টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং এরমধ্যে ৬টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল।
নদ-নদীর প্রবাহ পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে পাউবো জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় যমুনা নদ বাহাদুরাবাদ, ফুলছড়ি ও মথুরা পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
গঙ্গা নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় বৃদ্ধি পেতে পারে। উত্তর-পূর্বে প্রধান নদীসমূহের পানি হ্রাস পাচ্ছে এবং আগামী ৪৮ ঘণ্টায় তা অব্যাহত থাকতে পারে।
প্রধান নদ-নদীর প্রবাহের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে গতকাল বিকাল পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, দেশের অন্যতম প্রধান অববাহিকা উত্তর জনপদ ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের সবক’টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ব্রহ্মপুত্র নদ কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা নদী কুড়িগ্রামে বিপদসীমার ২২ এবং দুধকুমার নদী পাটেশ^রীতে ১১ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
যমুনা নদ ৪টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে সারিয়াকান্দি ও কাজীপুরে ১০, সিরাজগঞ্জে ১৭ এবং আরিচায় এক সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। উত্তর-মধ্যাঞ্চলে আত্রাই নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে বাঘাবাড়ীতে বিপদসীমার ৩১ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মধ্যাঞ্চলে ধলেশ^রী নদীর পানি কিছুটা বেড়ে এলাসিন ঘাটে বিপদসীমার ২৯ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে।
পদ্মা নদীর পানি কোথাও হ্রাস কোথাও অপরিবর্তিত রয়েছে। পদ্মায় পানি গোয়ালন্দে বিপদসীমার ৪৫ সে.মি. এবং সুরেশ^রে এক সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মেঘনা নদীর ভাটি-মোহনায় চাঁদপুরে পানি বিপদসীমার ৩ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সাতক্ষীরার কলারোয়ায় বেতনা নদীর পানি কিছুটা বেড়ে বিপদসীমার ১৯ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় উজানে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হয়েছে। এরমধ্যে ধুবরিতে ৯১, চেরাপুঞ্জিতে ৭৬ মিলিমিটারসহ বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টিপাত হয়েছে। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে নদ-নদী অববাহিকা এলাকাসমূহের মধ্যে, ময়মনসিংহে ১৪৩, বগুড়ায় ৯৫, কুষ্টিয়া ও সাতক্ষীরায় ৬৪, লালাখালে ৬২, ভাগ্যকুলে ৫৮, সিলেটে ৫৭, মনু রেলব্রিজ পয়েন্টে ৫৬, ডালিয়ায় ৫৫, নোয়াখালীতে ৫৩, জারিয়াজঞ্জাইলে ৫০ মি.মি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে পাউবো।
বগুড়া ব্যুরো জানায়, বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় বগুড়ায় যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬ টায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রলজি বিভাগ জানায় যমুনায় পানি বিপদসীমার ১১ সে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাউবো কর্তৃপক্ষের মতে এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, গত কয়েক দিনের উজানের ঢলে ও অবিরাম বৃষ্টিতে কুড়িগ্রামে সবকটি নদনদীর পানি প্রতিদিনই হুহু করে বেড়েই চলেছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ধরলা নদীর পনি বেড়ে বিপদসীমার ২২ সে.মি ওপর দিয়ে এবং ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বেড়ে চিলমারী পয়েন্টে ৯ সে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলার বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে।
কুষ্টিয়া থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, ভেঙে গেছে কুষ্টিয়ার শেখ রাসেল সেতুর পাদদেশে গড়াই নদীর ক‚লের বøক বাঁধ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির কারণেই এ বেহাল দশা বলে অভিযোগ করেছেন হাটশ হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম শম্পা মাহমুদ। কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপসহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এক ঘণ্টায় ৩০ মিটার বøকবাঁধ ভেঙে পানিতে তলিয়ে গেছে। এখনো ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। সেখানে বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে।
মধুখালী (ফরিদপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কামারখালী ইউনিয়নে গড়াই ও মধুমতির নদীর পানি বৃদ্ধিতে ভাঙনের তীব্রতা দেখা দিয়েছে। নদী ভাঙনের কবলে পরে সালামতপুর বর্তমান রঊফ নগর গ্রামের নদীর পাশ দিয়ে মানুষের যাতায়াতের রাস্তা বিলীন হয়ে গেছে।
পিরোজপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, পিরোজপুরের নাজিরপুরে গাঁওখালী বাজার সংলগ্ন সড়কটি ভাঙনের কবলে পড়ে প্রায় ১৫ ফুট নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
রংপুর থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, তিস্তা নদীর ভয়াবহ ভাঙনে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে গঙ্গাচড়া উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ৫টি গ্রাম। চলতি বন্যা মৌসুমে ইতিমধ্যে ৪০-৪৫টি পরিবারের ঘর-বাড়িসহ হেক্টর হেক্টর ফসলি জমি, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, মসজিদ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। দিনের পর দিন ভাঙন তীব্র হচ্ছে।
টাঙ্গাইল জেলা সংবাদদাতা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় টাঙ্গাইলে যমুনা, ধলেশ্বরী ও ঝিনাইসহ অনান্য শাখা নদীর নদী পানি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। যমুনা নদীর পানি ৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার, ধলেশ্বরী নদীর পানি ৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার এবং ঝিনাই নদীর পানি ৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন