শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মুরগি-মাছ ব্যবসায়ীরা স্বাস্থ্যের ঠিকাদার

কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের চালচিত্র

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০২১, ১২:০০ এএম

মেসার্স জেরিন এন্টারপ্রাইজ। নাম ঠিকানাহীন একটি প্রতিষ্ঠান। কখনোই স্বাস্থ্যখাতের মতো একটি সংবেদনশীল খাতে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু গত বছরের ৩ জুন সিএমএসডি’র (সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর ডিপো বা কেন্দ্রীয় ঔষধাগার) পরিচালক হিসেবে আবু হেনা মোরশেদ জামান দায়িত্ব নেয়ার পরপরই প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. জায়েদুল হোসেন ভূঞা’র কপাল খুলে যায়। দায়িত্ব নেয়ার ১২ দিনের মাথায় ১৫ জুন প্রতিষ্ঠানটিকে ৩৪ কোটি ৫০ লাখ টাকার পিসিআর টেস্ট কিট ক্রয়ের কাজ দেয়া হয়। বাজার দরের থেকে ৫ গুণ বেশি দামে ২৩শ’ টাকা দরে ১ লাখ ৫০ হাজার স্যানশিওর বায়োটেক ব্র্যান্ডের টেস্ট কিটের কার্যাদেশ দেয়া হয়।
এক সময়ে মোবাইল ব্যবসায়ী শামীম আশরাফি। সিএমএসডি’র বর্তমান পরিচালক দায়িত্ব নেয়ার পর কপাল খুলে যায়। হয়ে যান স্বাস্থ্যখাতের ঠিকাদার। মেডিকিট করপোরেশনের নামে এ পর্যন্ত কয়েকশ’ কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে তিনি ব্যবহার করেছেন সাউথ বাংলা ট্রেড, মেডিকো বাংলা, দেশ বাংলা, চায়না-বাংলা হাব নামীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে। সিএমএসডি’র উপ-সচিব ডা. শরীফ মুহম্মদ ফয়েজুল আলমের কাছের মানুষ হওয়ায় অনায়াসেই পেয়েছেন এ কাজ। শামীমের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দেশ বাংলা’র যাত্রাবাড়ীতে মাছের আড়ৎ ছিল। পাশাপাশি চায়না-বাংলা’র ব্যবসা ছিল মুরগীর ফিড আমদানি করা।
কয়েক মাস আগে মৃত্যুবরণ করেছেন ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য আসলামুল হক। তিনি মায়িশা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি ভূমি ব্যবস্থাপনা, রিয়েল এস্টেট, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রয়, কেমিক্যাল আমদানি, কনজ্যুমার প্রোডাক্টস ও ট্রেডিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু আবু হেনা মোরশেদ জামান দায়িত্ব নেয়ার পর সিএমএসডিতে স্বাস্থ্যখাতের মতো সংবেদনশীল কাজের ঠিকাদার বনে যান। বর্তমান পরিচালক বড় অঙ্কের কমিশন নিয়ে আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকার হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা’র কার্যাদেশ দেন সাড়ে ৯ লাখ টাকার বেশি দামে। পরে অবশ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতনদের হস্তক্ষেপে ৫ লাখ টাকার কিছু বেশি দামে কার্যাদেশ পায় প্রতিষ্ঠানটি।
কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান পরিচালক দায়িত্ব নেয়ার পর সিএমএসডিতে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে কাজ করা ঠিকাদাররা অনেকটাই বঞ্চিত। পরিচালক কখনো আত্মীয়স্বজন, আস্থাভাজন, কমিশন বেশি পাওয়া যাবে এরকম মাছ ব্যবসায়ী, মোবাইল ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের ধরে এনে স্বাস্থ্যখাতের সংবেদনশীল কাজের কার্যাদেশ দিয়েছেন। সূত্র মতে, সিএমএসডি’র প্রতিটি কাজই এই সিন্ডিকেটের দখলে। পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামানের তত্ত্বাবধানে সিন্ডিকেটকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিএমএসডি’র উপ-সচিব ডা. শরীফ মুহম্মদ ফয়েজুল আলম এবং সিনিয়র সহকারী সচিব ও সমন্বয়ক মো. মাহবুব আলম। সিন্ডিকেট ঠিকাদারদের কাছ থেকে মালামাল দেয়ার আগেই ২৫ শতাংশ কমিশন পেয়ে যাচ্ছেন তারা।
এই সিন্ডকেটের দাপটে সিএমএসডি’র কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও দীর্ঘদিন থেকে আতঙ্কে আছেন। ভুঁইফোঁড় বিভিন্ন ঠিকাদারদের কীটসহ হাসপাতালের সংবেদনশীল যন্ত্রপাতি কেনাকাটার নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মোবাইল ব্যবসায়ী থেকে স্বাস্থ্যের ঠিকাদারে পরিণত হওয়া শামীম আশরাফিকে সব ধরনের সাপোর্ট দিচ্ছেন সিএমএসডি’র উপ-সচিব ডা. শরীফ মুহম্মদ ফয়েজুল আলম।
সূত্র জানায়, গত ১ বছরে শামীম আশরাফি বসুন্ধরা ও ধানমন্ডীতে ফ্ল্যাট কিনেছেন। কিনেছেন একাধিক দামি গাড়ি। শামীম আশরাফি শুধু নিজেই বিভিন্ন নামে সিএমএসডি’র কাজ নেননি। তার তদবিরেই মেডিটেক ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান সিএমএসডিতে ঠিকাদারী কাজ করছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বাস্থ্য সেবা খাতে সকল বড় ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রয়কারী কার্যালয়ের প্রধান হচ্ছে সিএমএসডি। আর ক্রয় প্রক্রিয়ার প্রধান ভূমিকা পালন করে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক। তিনি ক্রয় কমিটির টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন কমিটির সভাপতি এবং টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির (টিইসি কমিটি) সেক্রেটারি। ক্রয় প্রক্রিয়ায় এই দুটি কমিটিই মূল ভূমিকা পালন করে। আর তাই নিজের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফন্দি আটেন সিএমএসডি পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান। সবকিছুতেই পরিচালক কৌশলে প্রভাব খাটিয়ে তার নিজের পছন্দের ঠিকাদারের দিয়ে কাজ বাগিয়ে নিয়ে নিম্নমানের মালামাল ক্রয় করছে। যা স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ স্বাস্থ্যখাতকে বিপাকে ফেলার এক ধরনের পায়তারা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিএমএসডি’র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা/কর্মচারী জানান, প্রতিষ্ঠানটির শুরু থেকে করোনার আগ পর্যন্ত যত পরিচালক দায়িত্ব নিয়েছেন। কেউই বর্তমান পরিচালকের মতো সিন্ডিকেট/লুটপাট করেননি। বর্তমান পরিচালক সবসময় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কথা বলে সবাইকে তটস্থ রাখেন। সিএমএসডি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের কোনো মতামতের গুরুত্ব দেন না। এছাড়াও সিএমএসডি’র পরিচালকের একগুয়েমির কারণে বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র চীনকে দেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার সামগ্রীর মাল দেয়া প্রতিষ্ঠানটির বিল এখনো মিলেনি। সরবরাহকৃত সুরক্ষা সামগ্রীর বিল না পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন সরবরাহকারী। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর চীনকে দেয়া উপহারের বিলই নয়; করোনার শুরুর দিকে যারা দেশের ক্রান্তিকালে সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান করে মহামারি মোকাবিলায় বিশেষ ভ‚মিকা রেখেছেন তাদের সকলের বিলও আটকে দিয়েছেন। এতে ১৯৬টি প্যাকেজের ১ হাজার ২৮৫ কোটি ২২ লাখ ৪১ হাজার টাকার বিল আটকে যায়।
সূত্র জানায়, পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান, উপ-সচিব ডা. শরীফ মুহম্মদ ফয়েজুল আলম এবং সিনিয়র সহকারী সচিব ও সমন্বয়ক মো. মাহবুব আলম এই তিনজনই সিএমএসডি’র সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এই তিনজন এক সঙ্গে মিটিং করে সকল প্রকার পিপিআর এবং পিপিএ অনুসরণ না করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সিএমএসডি কর্মকর্তা/কর্মচারীর উপর চাপিয়ে দেন। যেমন- গত ২২ আগস্ট আরটিপিসিআর কিট ক্রয়ের পিপিআর এবং পিপিএ’তে প্রথমে ৩ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হলেও পরবর্তীতে ২৫ আগস্ট ১ বছরে করে দেয়া হয়েছে। কারণ ৩ বছর দিলে অনেক প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশগ্রহণ করতো। আর ১ বছর দেয়ায় বর্তমান পরিচালক দায়িত্ব নেয়ার পর যেসব মাছ ব্যবসায়ী, মোবাইল ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের কিট সরবরাহের কাজ দিয়েছেন তারাই যোগ্য হিসেবে দরপত্রে অংশগ্রহণ করবে। আর সু-কৌশলে তাদেরকেই কিট ক্রয়ের দরপত্র দেয়ার সব আয়োজন সঠিকভাবে করতে পারবেন।
সিএমএসডি’র পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Md Mijanur Rahman ৩১ আগস্ট, ২০২১, ৮:৩২ এএম says : 0
CHORE CHORE MASHTUTO VAI ER JAT AMRA
Total Reply(0)
মোঃ আকতার হোসেন মীর ৩১ আগস্ট, ২০২১, ৯:৪১ এএম says : 0
বাংলাদেশে এখন আর কোন কিছুতে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না । প্রয়োজন শুধু টাকা আর মামার ।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন