ঘরে বসে পণ্য কেনা বাংলাদেশে এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। করোনাকাল এটিকে পৌঁছে দিয়েছে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে, পোষাক-পরিচ্ছদ, প্রশাধনী, অলংকার, আসবাবপত্র, গাড়ী, বইপত্র, ওষুধ, জমি, ফ্ল্যাট সবই কেনাকাটা হচ্ছে এই মাধ্যমে। গ্রাহকের আগ্রহ, জনপ্রিয়তার কারণে বিগত কয়েকবছর ধরে বিপুল সংখ্যক উদ্যোক্তাও তৈরি হয়েছে ই-কমার্সে। বাংলাদেশের বাজারের সম্ভাবনা পর্যবেক্ষণ করে বিদেশী ই-কমার্স জায়ান্ট আলিবাবা, অ্যামাজন, ওয়ালমার্টের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশে ব্যবসা চালু করার জন্য কাজ করছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর এখন আস্থার সঙ্কটে ভুগছে গোটা খাতই। ধীরে ধীরে গ্রাহকদের নেতিবাচক ধারনা সৃষ্টি হচ্ছে ই-কমার্সের প্রতি। এতে সামগ্রিকভাবে দ্রুতবর্ধমান এবং সম্ভাবনাময় খাতটি ভেঙে পড়তে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতারণাকারী ও অস্থিরতা সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুতই দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে গ্রাহকদের আস্থা ফেরানোই চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদেশী ই-কমার্স জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি অশুভ লক্ষণ। দ্রুত গ্রাহকদের আস্থা অর্জন এবং সঙ্কটের সমাধান না করলে অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠান ফিরে যাবে।
স¤প্রতি খুব অল্প সময়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়া কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতসহ গ্রাহক ও মার্চেন্টদের সাথে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। শুরুতে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের আকর্ষণ করতে অস্বাভাবিক সব অফার দেয়। পরে দেখা যায় যে অগ্রিম অর্থ নিলেও প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তারা সময়মত পণ্য সরবরাহ করছে না। ভোক্তাদের অভিযোগ, পণ্যের টাকা পরিশোধ করা সত্তে¡ও নির্ধারিত সময়ে তারা পণ্য পাচ্ছেন না। কারো কারো ক্ষেত্রে সেটি নির্ধারিত সময়ের ৬ মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত অতিক্রম করছে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য সরবরাহকারী বা মার্চেন্টরা বলছেন, দিনের পর দিন তাদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে না। দীর্ঘ সময় ধরে এ অর্থ আটকে থাকছে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। কয়েক মাস পর পণ্য স্টকে নেই বলে গ্রাহকদের হয়রানি করা হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রাহক বা মার্চেন্টদের সাথে কোন যোগাযোগই রাখছে না ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। শুরুর দিকে যেভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতো পরবর্তীতে যোগাযোগের সব মাধ্যমই তারা বন্ধ করে দিচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও ই-কমার্স বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরুর দিকে এক ধরনের ডিসকাউন্ট/সাইক্লোন অফার চালু করে ২০ শতাংশ-১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক দেয়া হবে বলে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে দেখা যায়। এসব অফারে গ্রাহকরা পণ্য তো পাবেনই আবার মূল টাকাও ফেরত পাবেন। অবিশ্বাস্য এমন সব অফার দেখে গ্রাহকরাও হুমড়ি খেয়ে পড়েন ওই ই-কমার্সে। শুরুতে তারা কিছু গ্রাহকের কাছে পণ্য সরবরাহ করলেও কয়েকদিনের মাথায় বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিয়েও যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ, সেইসঙ্গে মার্চেন্টদের পাওনা পরিশোধ করছে না বলে অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতটি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
ই-কমার্সখাতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে মূলত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এর মধ্যে রয়েছে- ইভ্যালি, ইঅরেঞ্জ, ধামাকা, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, কিউকম, দালাল প্লাস, বাজাজ কালেকশন, টুয়েন্টিফোর টিকেট ডট কম, গ্রিন বাংলা, এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড এ্যাগ্রো ফুড এন্ড কনজ্যুমারসহ আরও কয়েকটি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ১৫ জুলাই পর্যন্ত ইভ্যালি যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক ও মার্চেন্ট কোম্পানি মিলিয়ে মোট দায়ের পরিমাণ প্রায় ৮৪৩ কোটি টাকা। অথচ প্রতিষ্ঠানটির মূলধন মাত্র ১ কোটি টাকা। কর্মকর্তারা জানান, ইভ্যালিকে তৃতীয় দফায় ‘মার্চেন্টদের কাছে দেনার পরিমাণ, গ্রাহক ও মার্চেন্টদের দায় পরিশোধের সময়বদ্ধ পরিকল্পনা’ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে জানাতে হবে ২ সেপ্টেম্বরের (আজ) মধ্যে। ওই পরিকল্পনা দেখে বলা যাবে প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে এসব দায়দেনা পরিশোধ করবে। ইভ্যালির মতো গ্রাহকের টাকা নিয়ে পণ্য না দেয়ার অভিযোগ ইঅরেঞ্জের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটি ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাত করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের মামলায় বর্তমানে ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানসহ তিনজন জেলখানায় আছে। অর্থ পাচারের অভিযোগ ধামাকার বিরুদ্ধে। একইভাবে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পণ্য না দেয়ার অভিযোগ সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদিনের প্রদীপসহ অন্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৩০ আগস্ট এক নির্দেশনায় বলেছে, গ্রাহকের কাছ থেকে পণ্য বা সেবার অগ্রিম মূল্য সরাসরি নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে নিতে পারবে না ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ঝুঁকি বিবেচনায় যথাযথ তদারকি নিশ্চিত করে লেনদেনের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ই-কমার্স খাতে আস্থার জায়গা ধরে রাখতে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় নীতিমালা ও নির্দেশিকা জারি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এসব নির্দেশনা কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে এর কতোটা প্রয়োগ হচ্ছে তা নিয়ে নজরদারির যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। নতুন নির্দেশিকায় প্রধানত পণ্য সরবরাহ ও রিফান্ড দেওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও ক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে পাঁচ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। ভিন্ন শহরে অবস্থান করলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য স্টকে না থাকলে সেটার কোন পেমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না। আগাম পরিশোধ করা টাকা পণ্য সরবরাহের পরই বিক্রেতার অ্যাকাউন্টে জমা হবে। ক্রেতার অগ্রিম মূল্য পরিশোধের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্যটি ডেলিভারি-ম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে তা টেলিফোন, ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে জানাবে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি-ম্যান পণ্যটি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবে।
এতে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য বা সেবা ডেলিভারি-ম্যানের কাছে হস্তান্তর করার মতো অবস্থায় না থাকলে ই-কমার্স কোম্পানি পণ্য মূল্যের ১০ শতাংশের বেশি অর্থ অগ্রিম নিতে পারবে না। তবে নীতিমালা ভঙ্গ করলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, যেমন কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল করা। কিন্তু নীতিমালা ভঙ্গ করলে দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা নেওয়ার কোন সুযোগ নেই।
নির্দেশনা থাকা সত্তে¡ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীরা বলেন, গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে ও বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানালেও দায়ীদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়নি। একের পর এক চিঠি/ নোটিশ দিয়ে এবং দফায় দফায় বৈঠক করে নানাভাবেই এই প্রক্রিয়াকে বিলম্ব করা হচ্ছে বলে তারা মনে করছেন।
ই-কর্মাস খাতে যে আস্থা সঙ্কট দেখা দিয়েছে তা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। সম্প্রতি ডিসিসিআই আয়োজিত এক ভার্চুয়াল আলোচনায় তিনি বলেন, কোটি কোটি গ্রাহক আর ব্যবসায়ী যদি লোভের কাছে পরাস্ত হয় তবে সরকারের একার পক্ষে তা সামাল দেওয়া অসম্ভব।
তিনি বলেন, লোভের মাত্রা বেড়ে গেলে ব্যবসায় দুপক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ব্যবসা ঝুঁকিতে পড়ে পারে, আবার ভোক্তাও ও পণ্য ও সেবা থেকে বঞ্চিত বা অর্থ খোয়াতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে প্রতিটি কেস ধরে ধরে সমস্যা সমাধান করা বা মামলা করা অসম্ভব। তাই দায়িত্ব নিতে হবে মার্চেন্ট ও ভোক্তাকেই।
সব বিষয় ই-কমার্স নীতিমালায় থাকবে না জানিয়ে বাণিজ্য সচিব বলেন, কিছু কিছু বিষয়ে মার্চেন্ট আর ভোক্তাদের ও সচেতনতা দরকার। ব্যবসায়ী ঝুঁকি নেবেন কিনা, ভোক্তা সব অফার গ্রহণ করবেন সে সিদ্ধান্ত তাদেরই নিতে হবে।
মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) কে দায়ী করে বলেন, অস্থিরতা ও প্রতারণার দায় অবশ্যই সংগঠনকে নিতে হবে। কোন একটি গার্মেন্টে সমস্যা হলে যেমন বিজিএমইএ এগিয়ে আসে তেমনি ভাবে ইক্যাবকেও এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের তাদের যে নিজস্ব ফান্ডে বিপুল অর্থ রয়েছে সেখান থেকে দিতে হবে।
আস্থা ফেরাতে সরকারকেও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করছে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে গ্রাহকদের পরিশোধ করতে পারে। কিংবা দায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তাহলে পরবর্তীতে আর কেউ এমনটি করবে না।
ই-ক্যাবের সভাপতি শমী কায়সার ও সেক্রেটারি আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ভোক্তা ও বিক্রেতাদের অভিযোগের পেক্ষিতে ই-ক্যাব ১৬ টি প্রতিষ্ঠানকে ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেছে। এরমধ্যে অভিযোগের বিষয়ে জবাব না দেয়া অথবা সন্তোষজনক জবাব না দেয়ার কারণে ৪টি প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। ৯টি প্রতিষ্ঠানকে পর্যবেক্ষণে রেখে অধিকতর তদন্ত চলছে।
গ্রাহকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, নিজেদের আর্থিক নিরাপত্তার স্বার্থে অস্বাভাবিক অফার দেয়া পণ্য কেনাকাটায় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান ‘‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নিরর্দেশিকা ২০২১‘’ প্রতিপালন করছেনা সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটা থেকে বিরত থাকার অনুরোধও করেন তারা।#
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন