মানবজাতি পৃথিবীতে সৃষ্টির সেরা জাতি। বিবেক বুদ্ধি ও অনুভুতির বিবেচনায় মানুষের পর্যায়ে পৃথিবীতে আর কোন মাখলুক নেই। মানুষ সংঘবদ্ধ ও সামাজিক জীব। মানুষের মধ্যে সে সকল মানুষই শ্রেষ্ঠ যারা সকল মানবীয় গুণে গুনান্বিত। পরোপকার মানবীয় মহৎ গুণ। সমাজ জীবনে একজন মানুষ অপর মানুষের সাথে চাল চলনে, কথা বার্তায়, লেনদেনে নিয়োজিত হতে হয়। মানুষ সমাজ জীবনে পরষ্পরের সুখে দুঃখে পরস্পর সহযোগী। বিপদে একজন অপরজনকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে। মানুষের সাথে মানুষের এ সহযোগীতামুলক কাজকে পরোপকার বলা হয়। একটি আদর্শ সমাজ, আদর্শ রাষ্ট্র গড়তে হলে সকলকে পরোপকারের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। পরোপকারে নিজেকে শামিল করতে হবে।
পরোপকার বিষয়ে পবিত্র কোরআন : পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও শান্তির ধর্ম ইসলাম তার সকল অনুসারীকে পরোপকার করার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন মাজীদে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির কল্যাণের (পরোপকারের) জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং মন্দ কাজে বাধা দেবে।’ (সুরা আলে-ইমরান: আয়াত: ১১০)। পবিত্র কুরআন মাজীদের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহপাক পরোপকার সম্পর্কে ইরশাদ করেন, ‘ এবং সালাত কায়েম করো আর যাকাত পরিশোধ করো। তোমাদের নিজেদের (আখিরাতের) জন্যে যে কোনো ভালো কাজই অগ্রিম পাঠাবে, তা অবশ্যি ওখানে গিয়ে আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যে আমলই করোনা কেন, অবশ্যি তা আল্লাহর দৃষ্টিতে রয়েছে। (সুরা আল বাকারা: আয়াত: ১১০)।
তিনি আরো বলেন, ‘ সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে - শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার। (সুরা আল বাকারা: আয়াত: ১৭৭)। তিনি আরো বলেন, ‘কে আছে যে আল্লাহকে কর্জে হাসানা উত্তম ঋণ দেবে, তাহলে তিনি তার জন্য একে বর্ধিত করে দেবেন এবং তার জন্য সম্মানজনক প্রতিদানও রয়েছে।’ (সুরা হাদিদ: আয়াত: ১১)।
পরোপকার বিষয়ে পবিত্র হাদিস : হাদীস শরীফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়াবি সমস্যাগুলোর একটি সমাধান করে দেয়, আল্লাহ তায়ালা তার আখিরাতের সংকটগুলোর একটি মোচন করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনে সাহায্য করবে, আল্লাহ তায়ালাও তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে স্বাচ্ছন্দ্য দান করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-গুণ গোপন করবে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন করবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে।’ (সহীহ মুসলিম: হাদিস নং: ২৬৯৯)।
হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন, যে তার বান্দাদের প্রতি দয়া করে।’ (সহীহ বোখারি: হাদিস : ১৭৩২)। তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় অপরের একটি প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে, পরকালে আল্লাহ তার ১০০ প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন এবং বান্দার দু:খ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন।’ (সহীহ মুসলিম: হাদিস : ২৫৬৬)। নোমান ইবনে বাশির (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সব মুমিন দেহের মতো। যখন তার চোখে যন্ত্রণা হয়, তখন তার পুরো শরীরই তা অনুভব করে। যদি তার মাথাব্যথা হয়, তাতে তার পুরো শরীরই বিচলিত হয়ে পড়ে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৬)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও এরশাদ করেন, ‘মুমিনরা পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক দেহের মতো। দেহের কোনো অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে পুরো দেহ সে ব্যথা অনুভব করে।’ (বোখারি, হাদিস : ৬০১১)।
বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণের জীবনে পরোপকারের ব্রত : পরোপকারের মহৎ এ গুণটি স্বয়ং বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে এর সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ ছিল। বিশ্বনবীর আদর্শ নমুনা প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম ওহিপ্রাপ্তির পর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে খাদিজা (রা.) কে বললেন, ‘আমাকে কম্বল দিয়ে জড়িয়ে দাও, আমি আমার জীবনের আশঙ্কা করছি।’ তখন খাদিজা (রা.) নবীজি (সা.) কে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ কখনোই আপনার অমঙ্গল করবেন না। কারণ, আপনি আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করেন, গরিব-দু:খীর জন্য কাজ করেন, অসহায়-এতিমের ভার বহন করেন, তাদের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।’ (বুখারি: ৪৫৭)।
রাসুল (সা.) এর সম্মানিত সাহাবায়ে কেরামগণও ছিলেন পরোপকারের অতুলনীয় আদর্শ। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) এর দানশীলতা ইসলামের ইতিহাসে পরোপকারের উৎকৃষ্ট নমুনা। তাঁর দান সম্পর্কিত ঘটনাটি হাদীসে এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে, ‘জায়দ ইবনে আসলাম (রহ.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, উমর (রা.) কে আমি বলতে শুনেছি, রাসুল (সা.) (তাবুকের যুদ্ধের সময়) আমাদেরকে দান-সদকা করার নির্দেশ দেন। সৌভাগ্যক্রমে ওই সময় আমার সম্পদও ছিল। আমি (মনে মনে) বললাম, যদি আমি কোন দিন আবু বকর (রা.)-কে অতিক্রম করে যেতে পারি, তাহলে আজই সেই সুযোগ। উমর (রা.) বলেন, আমি আমার অর্ধেক সম্পদ নিয়ে আসলাম। রাসুল (সা.) বললেন, তোমার পরিবার-পরিজনদের জন্য তুমি কি রেখে এসেছ? আমি বললাম, এর সমপরিমাণ। আর আবু বকর (রা.) তাঁর পুরো সম্পদ নিয়ে এলেন। তিনি বললেন, হে আবু বকর! তোমার পরিবার-পরিজনদের জন্য তুমি কি রেখে এসেছ? তিনি বললেন, তাদের জন্য আল্লাহ ও তার রাসুলকেই রেখে এসেছি। আমি (মনে মনে) বললাম, আমি কখনও আবু বাকর (রা.)-কে অতিক্রম করতে পারব না। (সুনানে তিরমিজি: হাদিস নং: ৩৬৭৫)। এ হাদিসের মধ্যে ওমর (রা.) এর দান সদকার মাধ্যমে পরোপকারের আদর্শ নমুনাটিও দেখতে পাওয়া যায়।
রাসুল (সা.) এর প্রিয়তম সহধর্মিনী উম্মুহাতুল মু'মেনীন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) এর পরোপকারের আদর্শ নমুনা সম্পর্কে হাদীসের মাধ্যমে জানা যায়। তাঁর পরোপকারের জন্য দানশীলতা প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীসে বর্ণিত রয়েছে, ‘উরওয়া ইবনে জুবাইর আয়েশা (রা.) সম্পর্কে বলেন, তাঁর কাছে (ধন-সম্পদ, অর্থ-কড়ির) যা আসতো সবই তিনি সদকা করে দিতেন। নিজের জন্য তিনি কিছুই জমা রাখতেন না।(সহীহুল বুখারি: হাদিস নং: ৩৫০৫ )।
আবু বকর (রা.) এর সময়ে মদিনায় একবার অনাবৃষ্টি ও ফসল উৎপাদন না হওয়ায় চরম দুর্ভোগ দেখা দেয়। লোকজন তখন আবু বকর (রা.)-এর কাছে বিষয়টি তুলে ধরলে তিনি তাদের সান্তনা দিয়ে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। তাই প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আল্লাহর সাহায্য কামনা করো। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা তাঁর কথার পর কিছু সময় অপেক্ষা করছিলাম। ইতিমধ্যে উসমান (রা.) এর সিরিয়ায় নিয়োজিত ব্যবসায়ীরা খাদ্য বা গম বোঝাই ১০০ উট নিয়ে মদিনায় উপস্থিত হলেন। এটা দেখে মদিনার ব্যবসায়ীরা উসমান (রা.)-এর দরজায় এসে তাঁদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরে বলেন, আপনার মজুদকৃত খাদ্যদ্রব্য আমাদের কাছে বিক্রি করে দিন, যাতে আমরা এর মাধ্যমে অভাব কাটিয়ে উঠতে পারি। উসমান (রা.) বলেন, ‘এটা তো খুব ভালো বিষয়! আচ্ছা তোমরা আমাকে এই ব্যবসায় কত লাভ দেবে?’ তারা বলেন, যদি আপনি ১০ দিরহামে ক্রয় করে থাকেন, তাহলে আমারা দুই দিরহাম লাভ দেব। উসমান (রা.) বলেন, ‘না, লাভ আরো বেশি দিতে হবে। ’ তখন তাঁরা বলেন, আচ্ছা পাঁচ দিরহাম লাভ দেব। তিনি আরো বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বললে ব্যবসায়ীরা বলেন, এর চেয়ে বেশি লাভ দেওয়া আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। এরপর তিনি তাঁদের বলেন, ‘শোনো! আমি এতক্ষণ তোমাদের সঙ্গে যে দর-কষাকষি করেছি, এটা এমনিতেই মজা করেছি। এখানে যত খাদ্যদ্রব্য আছে, আমি মদিনাবাসীর অভুক্তদের মাঝে সব সদকা করে দিলাম। ’ (উসমান বিন আফফান জিন্নুরাইন, মোহাম্মদ রেজা, পৃষ্ঠা ৩৬)।
হিজরতপূর্ব মক্কায় কাফের কুরাইশ সম্প্রদায়ের অত্যাচার সত্বেও রাসুল (সা.) এবং তাঁর প্রিয় সহচরবৃন্দ পরোপকারের জন্য নিজেদের জান মাল কুরবানী করেছেন। হিজরত পরবর্তী সময়ে মদীনায় আনসার সাহাবীগণ কৃর্তক মুহাজির সাহাবীগণের প্রতি জানমাল এমনকি পারিবারিক জিন্দেগী কুরবানীর নজরানা ইসলামের ইতিহাস ও মানবতার সেবায় মাইলফলক হয়ে থাকবে। মানবিক প্রশ্নে পরোপকারের উৎসাহ ও পরোপকারের আদর্শ নমুনা পৃথিবীর প্রায় ধর্মে রয়েছে। আসুন আমরা সবাই নিজেদেরকে পরোপকারে নিয়োজিত করি। মানবতার সেবায় নিয়োজিত হয়ে ইহ ও পরকালের সমুহ কল্যাণ লাভ করি। আল্লাহপাক আমাদেরকে এ বিষয়ে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন