শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

রাজধানীর সর্বত্রই ডেঙ্গু ভীতি

নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘ডেনভি-৩’ মৃত্যুঝুঁকি বেশি এডিস মশার কামড়ে মারা গেছে ৫১ জন আক্রান্ত আরো ২৬৫ রোগীর হাসপাতালে ভর্তি

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০০ এএম

করোনাভাইরাসের লাগাম টেনে ধরা গেছে। গতকাল করোনা শনান্ত ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে নেমে এসেছে। কয়েক মাস আগেও এই সংখ্যা ছিল ৩০ এর উপর। মৃত্যুর সংখ্যাও কমে গেছে। কিন্তু ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ ডেঙ্গুর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। রাজধানী ঢাকার সর্বোত্রই ডেঙ্গু ভীতি। এডিস মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ মানুষ। প্রতিদিন রাজধানী ঢাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত এডিস মশার লার্ভা পেলে নাগরিকের জরিমানা করছে। গতকাল সরকরি কর্মকর্তা তথা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলীর নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুই মেয়রের দাবি মশা নিধনের কার্যক্রম চলছে। কিন্তু ডেঙ্গু মশা নিধন হচ্ছে না। প্রতিদিন গড়ে আড়াইশ’র বেশি রোগী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। ইতোমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো এসিড মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, এডিসের লার্ভার খোঁজে দুই সিটির মেয়র ভ্রাম্যমাণ আদালত বসালেও লার্ভা নিধনের কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। মশা মারার চেয়ে মশা কার্যকর্মের প্রচারণাই বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ২৬৫ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ২৩২ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৩ জন। এনিয়ে দেশে ডেঙ্গুতে শনাক্তের সংখ্যা ১১ হাজার ৫০০ জন ছাড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অধিকাংশ রোগীই রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা। সবমিলিয়ে এই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে না মারা গেছেন ৫১ জন।

গতকাল শনিবার সারাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নতুন ২৬৫ জন ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৭৩ জনে। রাজধানী ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১ হাজার ১৩৭ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১৩৬ জন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে সর্বমোট রোগী ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৫০১ জন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১০ হাজার ১৭৪ জন রোগী।

রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার পর এ নিয়ে গবেষণায় নামের বিশেষজ্ঞরা। গবেষণা করে তারা জানান, ডেঙ্গুজ্বর রোগের নতুন ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এর নাম ডেনভি-৩। এটা আগের ভ্যারিয়েন্ট ডেনভি-১ ও ডেনভি-২ এর চেয়ে ডেনভি-৩ বেশি ভয়ঙ্কর। এই ভ্যারিয়েন্টে আগের চেয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। ৩০ আগস্ট গবেষকরা জানিয়েছেন ঢাকার একটি হাসপাতালের ডেঙ্গুর ২০টি নমুনার জিনোম সিকুয়েন্স করে এমন তথ্য গবেষণায় পাওয়া গেছে।
বিসিএসআইআর’র উদ্যোগে পরিচালিত এই গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ যা ডেনভি-১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩ ও ডেনভি-৪ এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে ডেনভি-৩ শনাক্ত হয় ২০১৭ সালে। ২০১৮ সালে ডেনভি-৩ এর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে এবং ২০১৯ সালে মহামারি আকার ধারণ করে।

অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে সংস্থাটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিম খান বলেন, দেশে প্রথম এই ধরন শনাক্ত হয় ২০১৭ সালে। ২০১৭ সালের আগে ডেনভি-১ ও ২ এ আক্রান্ত হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে অনেকের। কিন্তু ডেনভি-৩ এর বিরুদ্ধে এই ক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। যারা আগের দুই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত তারা নতুন করে ডেনভি-৩ আক্রান্ত হলে হেমোরেজ বা সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়েছে। তাই এবার মৃত্যু বেশি। তিনি আরও জানান, মায়ের দুধ পান করলে শিশুর ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন গবেষণায়।
বিসিএসআইআর’র বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই গবেষণার মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাসের জীবন-রহস্য উন্মোচনের ফলে সংক্রমিত সেরোটাইপ শনাক্ত করে ভাইরাসের বিস্তার রোধ, আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় সহায়তাকরণ, কার্যকারী একটি ডেঙ্গু ভাইরাস রোগ শনাক্তকরণ কিট ও ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রাখবে।

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাইফুল্লাহ মুন্সি বলেন, বিসিএসআইআরের এই সিকোয়েন্সিং ভবিষ্যতে টিকা উৎপাদনে সহায়ক হবে। এবার ডেঙ্গু ডেনভি-৩ ভ্যারিয়েন্টে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এটা ডেনভি-১, ২ এর চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর। এর আগে ২০১৩ থেকে ১৬ পর্যন্ত ডেনভি-১ এবং ডেনভি-২ দিয়ে আক্রান্ত হয়েছে মানুষ। যারা সেরোটাইপ-১ এবং সেরোটাইপ-২ আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে সেরোটাইপ-৩ এ আক্রান্ত হচ্ছেন তারা হেমোরোজিক হচ্ছেন, শক হচ্ছে। এতে মৃত্যুর ঝুঁকিটা বেড়ে যায়।

রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, বছরের প্রথম ৭ মাসে ১২ জনের মৃত্যু হলেও গত আগস্ট মাসে ৩৩ জনের মৃত্যু হয়। এমনকি সেপ্টেম্বরের প্রথম চার দিনেই পাঁচজনের মৃত্যু নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সবমিলিয়ে ডেঙ্গু উপসর্গ নিয়ে চলতি বছর ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
গত জানুয়ারিতে ৩২ জনের দেহে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বছর শুরু হয়। জুন মাসে এটি ১৭২ জনে ওঠে। জুলাই মাসে সেটিই হয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ২৮৬ জন। সব মিলিয়ে চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে ডেঙ্গুতে মোট শনাক্ত দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৫৮ জন। জুলাই থেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি দ্রæত খারাপ হতে শুরু করে। গত আগস্টে হুহু করে বাড়তে থাকে ডেঙ্গু রোগী। প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চিত্রটি উদ্বেগজনক হয়ে পড়ে। ওই মাসটিতে ডেঙ্গু রোগী দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৬৯৮ জন। এরপর সেপ্টেম্বরের প্রথম চার দিনেই ১ হাজার ১৪৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

এর আগে ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করে। রাজধানী ঢাকার হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীতে ভরে যায়। ওই বছর ১ লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। মারা যান ১৪৮ জন। ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় ২০০২ সালে; সে সময় ৫৮ জনের মৃত্যুর সংবাদ দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
এছাড়া ২০০১ সালে ৪৪ জন মারা যান। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেও করোনা মহামারি শুরুর বছর ২০২০ সালে ডেঙ্গু তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। তবে চলতি বছর উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন