দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। প্রধান নদ-নদীর পানি কোথাও কমছে, কোথাও বাড়ছে। কোথাও অপরিবর্তিত বা থমকে আছে। সার্বিকভাবে কমছে নদ-নদীসমূহের পানি। তবে ব্যাপক নদীভাঙন অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই ভাঙছে নতুন নতুন এলাকা। বন্যা-নদীভাঙনে অসহায় হাজারো মানুষ। ভিটেমাটি, ফসলের জমি, ক্ষেত-খামার, রাস্তাঘাট গ্রাস করছে প্রমত্তা নদী। উত্তর জনপদের কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধা থেকে ভাটিতে শরীয়তপুর-ফরিদপুর হয়ে চাঁদপুর মোহনা ও দক্ষিণ-পূর্বে ফেনী পর্যন্ত বন্যা আর নদীভাঙনে এখনো লাখো মানুষ পানিবন্দি এবং গৃহহারা। বগুড়ার সারিয়াকান্দির চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এছাড়া বন্যায় ২৮টি সরকারি প্রাথমিক ও দু’টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় পানিতে নিমজ্জিত। ভাঙন আতঙ্কে ঘুম নেই নদ-নদী সংলগ্ন এলাকাবাসীর। বন্যা-ভাঙনকবলিতদের খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, থাকার আশ্রয়, চিকিৎসার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ত্রাণের জন্য বানভাসিদের চলছে হাহাকার। তাদের পাশে কেউ নেই। উঁচু বাঁধে খোলা আকাশের নিচ্ছে অনাহারে বানভাসিদের দিন কাটছে। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে যমুনার ভাঙনে সর্বসান্ত মানুষ থাকার জায়গা না পেয়ে খোলা আকাশের নিচে পলিথিনের ছাউনি দিয়ে রাত কাটাচ্ছে। এখনও তাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা ছাড়া বিভিন্ন প্রদেশে গত কয়েক দিন বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় উজানের ঢল কমেছে। হিমালয় পাদদেশীয় ও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ, বিহারেও কমেছে বর্ষণ। দেশের অভ্যন্তরেও বৃষ্টিপাত আপাতত হ্রাস পেয়েছে। তবে গতকাল ভারতের উড়িষ্যা উপকূল বরাবর উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও সংলগ্ন পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ায় এর প্রভাবে আবারো বৃষ্টিপাতের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে একথা জানা যায়।
নদ-নদীর প্রবাহ পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীসমূহের পানি হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে এবং তা আগামী ২৪ ঘণ্টায় হ্রাস পেতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নদীসমূহের পানি হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে।
পাউবোর কেন্দ্র জানায়, গতকাল বিকাল পর্যন্ত ৮টি নদ-নদী ১৫টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়। নদীগুলো হচ্ছে- যমুনা, পদ্মা, আত্রাই, ধলেশ্বরী, গড়াই, কালিগঙ্গা, তুরাগ ও মুহুরী। প্রধান নদ-নদীসমূহের ১০৯টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৪৬টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৫৯টিতে হ্রাস পাচ্ছে ও ৪টি পয়েন্টে পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। রোববার নদ-নদীর ৩৯টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৬৬টিতে হ্রাস, ৪টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং ৯টি নদ-নদী ২০টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল। শনিবার ৯টি নদ-নদী ২১টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল।
বর্তমানে দেশের উত্তর, মধ্যাঞ্চল থেকে ভাটি হয়ে পদ্মা-মেঘনার মোহনা পর্যন্ত ১৩টি জেলা বন্যাকবলিত। জেলাগুলো হচ্ছে- কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুর।
ত্রিপুরায় ভারী বৃষ্টির ফলে ভারতের ঢলে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অববাহিকায় মুহুরী নদীর পানি বৃদ্ধি এবং আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ফেনীর পরশুরামে মুহুরী নদীর পানি গতকাল সকালে বিপদসীমার ১৩৪ সে.মি. এবং বিকাল নাগাদ হ্রাস পেয়ে ৭৮ সে. মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এদিকে উত্তরাঞ্চলে নদ-নদীর উজান থেকে ভাটির দিকে পানির এখন তীব্র প্রবাহ। এর ফলে মধ্যাঞ্চল হয়ে চাঁদপুর, ভোলা, বরিশাল মোহনা পর্যন্ত পানির প্রবল চাপে ফুঁসে উঠেছে।
বন্যা ও নদীভাঙনের সার্বিক অবস্থা নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।
সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী জানান, জেলার ৯টি উপজেলায় বন্যা ও লাগাতার ভারী বর্ষণে রোপা আমনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ অসংখ্য বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তাঁত সমৃদ্ধ তাঁতপল্লীর লক্ষাধিক তাঁতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যার্তরা পরিত্যক্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে অনেক দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করছে। সব মিলিয়ে সিরাজগঞ্জের বানভাসি মানুষের অবস্থা নাকাল হয়ে পড়েছে। ত্রাণ তৎপরতাও অপ্রতুল বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ জেলায় চলতি বছরে রোপা আমন আবাদে সমগ্র জেলায় ৭ হাজার ১৯২ হেক্টর জমির ফসল ও প্রায় ১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির অন্যান্য ফসল বন্যার পানি ও ভারী বর্ষণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে জেলায় প্রায় ৯ হাজার হেক্টর জমির ফসল হারিয়ে কৃষকেরা নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে। সেই সাথে বন্যায় জেলার ৫টি নদী-তীরবর্তী এলাকায় নদীভাঙনে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, হাটবাজার ও কার্লভার্ট নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। যমুনার ভাঙনে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ রিক্ত, নিঃস্ব সর্বসান্ত হয়ে পড়েছে। জেলার শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের পাকুরতলা ও জালালপুর গ্রামে যমুনার ভাঙনের মুখে পড়ে সর্বসান্ত মানুষ থাকার জায়গা না পেয়ে খোলা আকাশের নিচে পলিথিনের ছাউনি দিয়ে রাত কাটাচ্ছে। এখনও তাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
কুড়িগ্রাম থেকে শফিকুল ইসলাম বেবু জানান, কুড়িগ্রামে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রযেছে। ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি কিছুটা কমলেও ধরলা ও তিস্তা অববাহিকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিনশ’ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ এখনও পানিবন্দি হয়ে আছে। এক সপ্তাহের বেশি সময় থেকে পানিবন্দি থাকতে থাকতে চরম খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে তারা। এসব মানুষ জ্বর ও পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকের হাত-পায়ে ঘা দেখা দিয়েছে। আজও ধরলার পানি ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা অববাহিকার কিংছিনাই, জয়কুমোর ও বড়াইবাড়ি এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৪০টি ঘর-বাড়ি ধরলার পানির তীব্র স্রোতে ভেসে গেছে। তবে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যান্য নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। মানুষের দুর্ভোগ এখনও কমেনি। দুর্গত এলাকায় খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও গবাদি পশুর খাদ্য সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠছে। বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে ও নৌকায় আশ্রয় নেয়া মানুষগুলো গবাদি পশুর সাথে থেকে চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। এসব মানুষ ত্রাণের আশায় অপেক্ষা করছে। জেলার বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে স্থানীয় এনজিও, বেসরকারি সংস্থা ও রাজনীতিবিদরা কেউই যাননি এখন। এর মধ্যেও বিভিন্ন এনজিওর কিস্তির টাকা তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মানিকগঞ্জ থেকে শাহীন তারেক জানান, যমুনার পানি বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে। এতে দৌলতপুর, শিবালয়, ঘিওর ও হরিরামপুর উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বেশি দুর্ভোগে পড়েছে চরাঞ্চলের মানুষ। এসব এলাকার মানুষ নৌকা ছাড়া যাতায়াত করতে পারছে না। অনেকে পরিবারের লোকজন কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অপর দিকে পানি বাড়ার সাথে নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে মানুষের ঘরবাড়ি, জমিজমা ও নানান প্রতিষ্ঠান।
লালমনিরহাট থেকে মো. আইয়ুব আলী বসুনীয়া জানান, গতকাল সকাল ৯টায় লালমনিরহাটের দোয়ানিতে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার অনেক নিচে থাকলেও গত মাসে দফায় দফায় বন্যার ফলে লালমনিরহাটের আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা ও সদর উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে চরাঞ্চলের রোপা আমনের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। মরিচ, পোটল, বেগুনসহ শাকসব্জির ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকেরা এখন দিশেহারা। তিস্তা অববাহিকায় ঘন ঘন বন্যার কারণে পানিবন্দি মানুষগুলোর দুর্ভোগ যখন চরমে তখন আবার নদীভাঙনের মুখে ভিটেমাটি হাড়িয়ে নিঃস্ব লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না ইউনিয়নের অনেক বাসিন্দা।
বরগুনা থেকে জাহাঙ্গীর কবীর মৃধা জানান, জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বরগুনার বেড়িবাঁধের বাইরে নিম্নাঞ্চল ও বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার পরিবার। ভেসে গেছে বসতবাড়ি ও পুকুরের মাছ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাকা আউশ ধান ও বীজতলা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন