হাবিবুর রহমান : অপরাধ যে-ই করবে তাকে শাস্তি পেতেই হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সিলেটে খালিজাকে হত্যাচেষ্টার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, অনেকে এটিকে দলীয় রূপ দিয়ে পানি ঘোলা করতে চাচ্ছেন। এখানে কোনো দলীয় কোন্দল ছিল না বা দলীয় কারণে মারতে যায়নি। প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাকে হত্যা করতে গেছে। কিছু পত্রিকা ও লোক এটাকে দলীয় হিসেবে প্রচার করছে। দলীয় হিসেবে তাদের প্রশ্রয় দেয়া হবে না জানিয়ে অপরাধ যে-ই করুক শাস্তি তাকে পেতেই হবে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের সমাপনী অধিবেশনে সংসদ নেতা বলেন, কিছু ঘটনা ঘটে দুঃখজনক। সিলেটে কোপানোর ঘটনাটা আমার কাছে অবাগ লেগেছে। যখন কোপায় তখন মানুষ দেখে ছবি তুলেছে, ভিডিও করেছে। কেউ বাঁচাতে এগিয়ে এলো না। তারা কি পারত না তাকে বাঁচাতে? তাদের হাতে কি কিছুই ছিল না ওই ছেলেটাকে ধাওয়া করার জন্য। এটি কি ধরনের মানবতা। কেন মানবিক মূল্যবোধ এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো কি তাকে ধাওয়া দিতে পারত না, তারা কি মেয়েটাকে রক্ষা করতে পারত না? কেন এই মানবিক মূল্যবোধগুলো হারিয়ে গেল।
তিনি বলেন, কিছু বড় বড় পত্রিকা, কিছু লোক এটিকে দলীয় হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করছে। এটি কোনো রাজনৈতিক বা দলীয় কোন্দল ছিল না। এ ঘটনা সবাই জানে, পত্র-পত্রিকায়ও এসেছে। যা প্রেমঘটিত। প্রেমে প্রত্যাখ্যান হওয়ায় এটি করেছে। প্রত্যাখ্যান হওয়ায় এভাবে কুপিয়ে মারবে? আমরা দলীয় হিসেবে প্রশ্রয় দেবো না। যারা অপরাধী, যেই অপরাধ করুক তাকে শাস্তি পেতে হবে। আর নৃশংসতা, প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা বিএনপিই শিখিয়েছে। কে কোন দল করে সেটি আমি দেখব না, দেখা হবে না। যে অপরাধী তার বিচার হবেই।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে আছে, এটা প্রমাণিত। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাও তা স্বীকার করতে বাধ্য। আমরা যখন সরকার গঠন করি, সারাবিশ্বে তখন অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজ করছিল। সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে আমরা আমাদের অর্থনীতি নীতিমালা বাস্তবায়ন করেছি বলেই আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সারাদেশে স্বীকৃতি পেয়েছে।
সরকারপ্রধান বলেন, সারাদেশে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। যেখানে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ধরনের কলকারখানা গড়ে উঠবে। যেখানে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, রফতানি বৃদ্ধি পাবে। ইতোমধ্যে আমাদের দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এই আয় আরো বৃদ্ধি পাবে। দারিদ্র্যের হার কমেছে। আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হবে। ইতোমধ্যে আমরা নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। কিন্তু সেখানে আমরা তৃপ্ত নই। আমরা আমাদের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে চাই।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এর প্রকৃত উদাহরণ হচ্ছে আমি বিদেশে বসেই অনলাইনে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ৫২টি ফাইল পাস করতে সক্ষম হয়েছি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমি যে পুরস্কার পেয়েছি তা আমার একার নয়, এটি এদেশের জনগণের। যতটুকু অর্জন তা বাংলাদেশের জনগণের। ভোটাররা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করায় এ পুরস্কার অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এজন্য জনগণকে বেশি কৃতজ্ঞতা জানাই।
আমি গর্বিত মা শেখ হাসিনা
মা হিসেবে নিজেকে গর্বিত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, কম্পিউটার কি জিনিস তা আগে ব্যবহার করতে পারতাম না। আমার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছ থেকেই প্রথম কম্পিউটার চালানো শিখেছি। ডিজিটাল শব্দটিও তার (সজীব ওয়াজেদ) দেয়া। এ জন্য ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পেরেছি। শুধু আমি নই, আমার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কার পেয়েছে।
তিনি বলেন, আগে অটিজম সম্পর্কে ততটা বুঝতাম না। যখন সায়মা হোসেন পুতুল অটিজম নিয়ে কাজ করা শুরু করল তখন এ সম্পর্কে জানতে পারি। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও পুতুল আজ কাজ করছে। দেশে যত অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়ে আছে তাদের জন্য সরকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নিয়েছে। অটিজম শিশুদের জন্য একটি একাডেমি গড়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জনগণকে সচেতন করতে হবে প্রতিবন্ধী ও অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা অবহেলিত নয়। তাদেরও মেধা বিকাশের অধিকার রয়েছে। এসব প্রতিবন্ধী-অটিজম শিশুদের কাজে লাগাতে হবে। আমি প্রতি বছর অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের আঁকা ছবি দিয়ে কার্ড তৈরি করি। তাদের মেধা বিকাশের জন্য ১ লাখ টাকা উপহার দেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মা হিসেবে আমার সন্তানদের স্নেহবঞ্চিত করেছি। খুব অল্প খরচে লেখাপড়ার জন্য হোস্টেলে রেখেছি। আমার বোন বিদেশে রিফিউজি হিসেবে থেকে সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। নিজেদের জীবনের জন্য আমরা কিছু চাই না সবকিছু চাওয়া-পাওয়া এদেশের জনগণের জন্য। আমার বাবা যে লক্ষ্যে দেশ স্বাধীন করেছে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি।
যুদ্ধাপরাধীদের যারা মন্ত্রী করেছে তাদের বিচার হবে
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে হত্যার মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদেরকে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উপদেষ্টা করেছিল। খালেদা জিয়া তাদের হাতে পতাকা দিয়ে মন্ত্রী বানিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার হয়েছে, বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে, ফাঁসি হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছিল কারণ তারা যুদ্ধাপরাধী। কিন্তু তাদের যারা মন্ত্রী করেছে তাদের বিচার কেন হবে না, তাদের বিচারও বাংলার মাটিতে হওয়া উচিত। এটাও অপরাধ, কারণ যে অপরাধ করে সে যেমন অপরাধী; আর অপরাধীদের সহায়তা করাও অপরাধ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দুঃখ লাগে যখন আমরা দেশের উন্নয়ন করছি, দেশের জন্য কাজ করছি তখনো কিছু কিছু মানুষ তাদের যে কর্মকা- মানুষকে দুঃখ দেয় কষ্ট দেয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের কথা যদি মনে করি। সেই নির্বাচন ঠেকানোর নামে বিএনপি-জামায়াত জোট যেভাবে মানুষকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। যানবাহনে আক্রমণ করেছে। জীবন্ত মানুষগুলো আগুনে দগ্ধ হয়েছে। আবার ২০১৫ সলে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বিএনপি নেত্রী প্রতিজ্ঞা করলেন আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাত না করে ঘরে ফিরবেন না। আর আন্দোলন ছিল মানুষ পুড়িয়ে মারা। কি লাভ হয়েছে তার? আমার একটাই প্রশ্নÑ অনেক সময় তারা অভিযোগ করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা। যারা মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে তাদের কি বিচার হবে না। যারা পোড়া ঘা নিয়ে আজকে বেঁচে আছে তাদের কি বিচার পাওয়ার অধিকা নেই? যারা মানুষ মারার সাথে জড়িত, যারা জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের বিচার অবশ্যই হবে। এই বিচার বাংলার মাটিতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা করছি। এটা জাতির কাছে দেয়া ওয়াদা। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা এই বিচার শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাকে হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের যে যাত্রা শুরু হয় তখন এই অবৈধ ক্ষমতা দখল করে, নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে জিয়াউর রহমান এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদেরকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী করেছিল, উপদেষ্টা করেছিল এমনকি খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের হাতে লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা দিয়েছিল তাদের মন্ত্রী করেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের যারা মন্ত্রী করেছে তাদের বিচার কেন হবে না। তাদেরও বিচার বাংলার মাটিতে হওয়া উচিত। এটাও অপরাধ। অপরাধীদের যারা সহযোগিতা করে তারা সমান অপরাধী। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক আন্তর্জাতিক মহল স্বীকার করতে বাধ্য। উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। তিনি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার কথা উল্লেখ করে সরকারের উন্ন্য়ন কর্মকা-ের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
দেশের ডিজিটাল উন্নতির কথা তুলে ধরে এক্ষেত্রে তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের সহায়তা অবদানের রয়েছে বলে জানান। দেশ ডিজিটাল দেশে পরিণত হয়েছে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী জানান, বিদেশে বসেও তিনি ৫১টি ফাইল নিষ্পত্তি করে আবার সেগুলো দেশে পাঠিযে দিয়ে কাজ চালিয়ে গেছেন।
ভারত-পাকিস্তানকে সংযত আচরণ করার আহ্বান
ভারত-পাকিস্তানকে সংযত আচরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি এটুকুই চাই যে, দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি বজায় থাকুক।
দশম জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেশী দুই দেশের প্রতি এ আহ্বান জানান। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো রকম সংঘাত হোক, কোনো রকম উত্তেজনা হোক সেটা আমরা কখনো চাই না। ভারত-পাকিস্তান বা যেকোনো দেশই হোক, কোনো দেশে সংঘাত হলে তার জন্য বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাজেই ভারত ও পাকিস্তান দু’টি দেশকেই আমি আহ্বান জানাব, তারা যেন সংযত আচরণ করে। তারা যেন কোনো রকমের উত্তেজনা সৃষ্টি না করে। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষগুলো যেন কোনোরকম কষ্টে না পড়ে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন