বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অপরাধ জগতে নতুন মুখ

প্রকাশের সময় : ৭ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : অপরাধ জগতে ওরা নতুন। স্থানীয় থানায় অপরাধীর তালিকায় ওদের নামও নেই। বয়সে তরুণ হলেও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের শূন্যস্থান দখল করে নিয়েছে ওরা। রাজধানীসহ সারাদেশের অপরাধের নেটওয়ার্কে নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযানে মাঝে মধ্যে ওদের দু’একজন সদস্য গ্রেফতারও হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কয়েক বছর আগে ঢাকা মহানগর পুলিশের আট বিভাগে মোট ৫১৬ জন উঠতি সন্ত্রাসীর একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। সেই তালিকা আর হালনাগাদ করা হয়নি। এতে করে নতুন মুখের অপরাধীদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অনেক কিছুই অজানা।   
রাজধানীর বিভিন্ন থানার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখন কোথাও কিছু ঘটালেই উঠতি বয়সীদের জটলা দেখা যায়। নতুন মুখের ওরা কারা, কোন এলাকায় থাকে তা কেউ বলতে পারে না। এরা কথায় কথায় হট্টগোল, মারামারি, অস্ত্র প্রদর্শন করে প্রাণনাশের হুমকী দিতেও দ্বিধা করে না। এক সাথে দলবেঁধে এসে হট্টগোল করে আবার নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে এদের সম্পর্কে জানতে চাইলে সঠিক তথ্য কেউই দিতে পারেন না। শুধু ধারণাশ্রিত তথ্যের উপর নির্ভর করে পুলিশকে এগুতে হয়। ঈদুল ফিতরের কয়েক দিন আগে রাজদানীর কদমতলী থানার দনিয়া বাজার সংলগ্ন একটি জুয়েলারি দোকানে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দিনের আলোতে উঠতি বয়সী কয়েকজন তরুণ মোটরসাইকেল নিয়ে এসে  প্রথমে ককটেল ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এরপর দোকানের ভিতরে প্রবেশ করে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা রুট করে আবার ককটেল ফাটিয়ে চলে যায়। প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, যারা এসেছিল তাদেরকে আমার মতো অনেকেই দেখেছে। কিন্তু কেউই চিনতে পারেনি। একই বয়সী এসব উঠতি বয়সীদের আগে কখনও এলাকায় দেখা যায় নি। শ্যামপুরের এক ভুক্তভোগি ব্যবসায়ী বলেন, ইদানিং জায়গা জমি নিয়ে কোনো বিরোধ বাধলেই ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসাবে নতুন মুখে কিছু কিশোর ও যুবকদের দেখা যায়। এরা এতোটাই বেয়াদব ও নিষ্ঠুর যে মানুষকে মানুষ মনে করে না। এদের সাথে কথা বলারও উপায় থাকে না। তার আগেই চড়-থাপ্পড় দিয়ে বসে। এরা কোমড়ে তাকা আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে প্রাণনাশের হুমকী দিতেও দ্বিধা করে না।
ভুক্তভোগিদের মতে, ঢাকাসহ সারা দেশের অপরাধ জগতে এখন নতুন মুখের অপরাধীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এক সময় রাজধানীতে পিচ্চি হান্নান, সুব্রত বাইন, কালা জাহাঙ্গীর, পিচ্চি হেলাল, আরমান, জিসান, কিলার আব্বাস, আলাউদ্দিন, মোল্লা মাসুদ, বিকাশ, প্রকাশ, ল্যাংরা মাসুদ, টোকাই সাগর, সুইডেন আসলাম, জোসেফ, ডাকাত শহীদ, কচির মতো সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য ছিল। তাদের নাম শুনলে সাধারণ মানুষ আঁতকে উঠতো। এরা চাঁদা দাবি করার পর কেউ টাকা দেননি এমন ঘটনা একেবারে বিরল। ২০০১ সালের ২৭ ডিসেম্বর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা করে তাদেরকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে।
এরপর পিচ্চি হান্নানসহ অনেকেই র‌্যাবের ক্রসফায়ারে মারা যায়। প্রাণ বাঁচাতে কেউ কেউ আমেরিকা, কানাডা ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যায়। এদের মধ্যে আরমান, কিলার আব্বাস, সুইডেন আসলামসহ বেশ কয়েকজন কারাগারে বন্দী। বর্তমানে তাদের শূন্যস্থান দখল করে নিয়েছে উঠতি বয়সের সন্ত্রাসীরা। নতুন মুখের এসব সন্ত্রাসীদের নাম আবার স্থানীয় থানায় অপরাধীদের তালিকায় নেই। জেলায় জেলায় অপরাধীদের নেটওয়ার্কেও নতুন মুখ যুক্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কারাবন্দি ও বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বসে নেই। তারা কারাগার বা বিদেশের মাটিতে বসেই অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণসহ চাঁদাবাজি করছে। কৌশলগত কারণে তারা এখন সহযোগি হিসাবে উঠতি বয়সীদের ব্যবহার করছে। পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী জানান, র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত কুখ্যাত সন্ত্রাসী ডাকাত শহীদ একেবারে কম বয়সীদের ব্যবহার করতো। ডাকত শহীদের হয়ে যারা অস্ত্রহাতে চাঁদা চাইতে আসতো তাদের চেহারা দেখলে মনেই হতো না এরা কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপের। মিরপুরের এক বাসিন্দা বলেন, শাহাদতবাহিনীর সদস্যদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। তারা এতোটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে কথা বলতে বলতে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে দিতো। ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তি বলেন, এখন অবশ্য সে অবস্থা নেই। গত বছরের ১৯ জুলাই মিরপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে চারটি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬০টি গুলিসহ পান্থ হোসেন দিপু ওরফে পিংকু (১৫) নামে এক কিশোরকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। দিপু রাজধানীর কম্বাইন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের এ লেবেলের ছাত্র ছিল।   মিরপুরে খালার বাসায় থেকে পড়ালেখা করত। সন্ত্রাসী বিকাশ-প্রকাশ গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। স্কুলছাত্র হওয়ায় কেউ তাকে সন্দেহের চোখে দেখত না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিকাশ গ্রুপের সন্ত্রাসীরা দিপুর কাছে অস্ত্র রাখত। তেজগাঁও এলাকার এক চাকরিজীবী বলেন, সোলাইমান ও কবির নামে দুই সন্ত্রাসী তেজগাঁও এলাকার অপরাধজগতে নতুন মুখ। এদের সহযোগিদের অনেকেই ছাত্রের মতো স্কুলব্যাগ নিয়ে চলাফেরা করে। তাদের বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা কিংবা সন্ত্রাসী তালিকায়ও তাদের নাম নেই। পুলিশ তাদের খুঁজেও পায় না। অথচ তাদের অনেকেরই হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। পুলিশ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা জানান, বড় বড় সন্ত্রাসীকে ধরতে দেশব্যাপী র‌্যাব এবং পুলিশের অভিযানের পর তারা গাঢাকা দিয়েছে। অনেকেই ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারে মারাও গেছে। সেই শূন্যস্থান পূরণে কিশোর সন্ত্রাসীদের উত্থান ঘটছে। এসব সন্ত্রাসীর অর্ধেকই পেশাদার খুনিতে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ছত্রছায়ায় থেকে তারা হত্যা, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধ করছে।
এসব বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোঃ ইউসুফ আলী বলেন, সন্ত্রাসীদের বিষয়ে পুলিশের গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। উঠতি বয়সী সন্ত্রাসীদের নিয়েও পুলিশের গোয়েন্দা কার্যক্রম ও তথ্য সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে। অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। এ বিষয়ে পুলিশ জিরো টলারেন্স নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন