স্টালিন সরকার (রৌমারী থেকে ফিরে) : কোন্টে যাইমেন বাহে? প্রশ্ন শুনেই সম্বিত ফিরে পেলাম। চিলমারী বন্দর থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় রৌমারী যাচ্ছি। দুই ঘন্টার পানি পথ। যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। ব্রহ্মপুত্র নদ যেন কূল-কিনারাহীন সাগর! মাঝে মাঝে চরে কাশবন সাদা মাথা তুলে জানান দিচ্ছে এটা শরৎকাল। চরে বাদামের ফলন ভাল হওয়ায় বাদাম সস্তা। সেটাই চিবুচ্ছি। প্রশ্ন শুনে পিছনে ফিরে তাকাতেই ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ আবার জানতে চাইলেন, কোনটে যাইমেন তোমরা? ‘বড়াইবাড়ি’। জবাব পছন্দ হলো না। ‘বড়াইবাড়ি দেখার একটা জায়গা হইলো বাহে!’ নৌকা উঠার কারণে ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। পেটে ক্ষুধা। একটু বিরক্তি প্রকাশ করতেই বলে উঠলেন, ‘চ্যাতেন ক্যা বাহে। ঢাকা থাকিয়্যা আছচেন, বড়াইবাড়ির থ্যাকি চিলমারীত অনেক কিছু দ্যাকার আছে। সেই জন্যো তোমাক কবার নাগছি বড়াইবাড়িত কিছু নাই।’ ততক্ষণে নৌকার ছইয়ের ওপরে বসা যাত্রীদের অর্ধেকের দৃষ্টি আমাদের দিকে চলে এসেছে। উৎসুক সবাই। প্রচ- রোদ, নৌকা এগিয়ে চলছে শব্দ করে।
বড়াইবাড়ি। না কোনো বরই-কুলের বাগান নয়। কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার ঐতিহাসিক মর্যাদা পাওয়া বড়াইবাড়ি সীমান্ত। ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে বড়াইবাড়ি ছিটমহলের ঘুমন্ত মানুষের ওপর নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বড়াইবাড়ি ছিটমহল ও বিজিবি ক্যাম্প দখলের বিএসএফ’র অপচেষ্টা প্রতিহত করে দেয় আমাদের বিজিবির (তখন নাম ছিল বিডিআর) জোয়ান এবং সীমান্তের মানুষ। সীমান্ত যুদ্ধে বিজিবির বীরত্বে ১৬ বিএসএফ সদস্য নিহত হয়। বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারান বিডিআরের নায়েক সুবেদার ওয়াহিদ মিয়া, সিপাহী মাহফুজুর রহমান এবং সিপাহী আবদুল কাদের। ওই ঘটনার সচিত্র খবর গোটা বিশ্ব মিডিয়ায় তোলপাড় হয়। ২০০১ সালের ওই ঘটনার পর থেকে বড়াইবাড়ি বাংলাদেশের মানুষের কাছে ঐতিহাসিক স্থান। সেই বড়াইবাড়ি যাব।
পথে অচেনা মানুষের দেয়া কোনো কিছু খেতে মানা। তারপরও পার্শ্বে বসা এক মহিলা আমার ঠোঙ্গা থেকে কয়েকটি বাদাম নিয়ে ছেলেকে দিলেন। অবুঝ শিশু বাদাম খাওয়ার বায়না ধরেছে। ছেলেকে নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা কারাগারে গিয়েছিলেন বন্দী স্বামীকে দেখতে। জমিজমা সংক্রান্ত মামলার আসামী স্বামী এখন কুড়িগ্রাম জেলা কারাগারে। আগামী সপ্তাহে জামিন হবে। নিজের থেকেই এসব জানালেন ফাতেমা নামের ত্রিশোর্ধ্ব মহিলা। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিরে চিরে বামে অষ্টমিরচর, বড়চর এবং ডাকে কর্ত্তিমারীরচর পিছনে ফেলে নৌকা এগিয়ে চলছে। ‘সাংবাদিক’ পরিচয় পেয়ে মোটর সাইকেলওয়ালা এক যুবক (মোটর সাইকেল নৌকার মাথায় বাঁধা) বললেন, আপনি ঢাকা থেকে গ্রামের চিত্র দেখতে এসেছেন। সকাল বিকালে গঞ্জের হাটবাজারে না গেলে প্রকৃত চিত্র বুঝবেন না। ধান কাটা শুরু না হওয়ায় মানুষের হাতে কাজ নেই। সকাল বিকেল বাজারে গিয়ে আড্ডা দেয়া গ্রামের অধিকাংশ মানুষের এখন নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ। দেশে রাজনীতির খবর নাই অথচ তারা তক্কা-তক্কি করে আজ একে ক্ষমতায় বসাচ্ছেন; কাল ওকে ক্ষমতা থেকে নামাচ্ছেন। এক কাপ চা দুই ভাগ করে খেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেন। দিল্লীতে কি হচ্ছে, কাশ্মীর সীমান্তে যুদ্ধের প্রস্তুতির খবর গ্রামের আড্ডাপ্রিয় মানুষের নখদর্পণে। দলীয় মার্কায় নির্বাচন হওয়ায় এবারের ইউনিয়ন পরিষদের ভোট পারিবারিক, সামাজিক ও আত্মীয়ে-আত্মীয়ে, ভাইয়ে-ভাইয়ে, মামা-ভাগ্নে, চাচা-ভাতিজায় বিরোধ উস্কে দিয়েছে। গ্রামে রাজনীতির নামে সামাজিক বিরোধ এখন চরম পর্যায়ে। হারাধন মাঝি নামের একজন ঢাকার রাজনীতির খবর চানতে চান। জবাব দেয়ার আগেই ফাতেমা (কারাবন্দী স্বামীকে দেখে ফেরা) বললেন, ‘থোনতো ভাই ঢাকার আজনীতি। বিএনপি ন্যাতাগুল্যার বিরুদ্ধে ১০টা থ্যাকিয়া ১২০টা পর্যন্ত মামলা বোলে দিচ্যে। হামরা একটা মামলার জ্যন্যো কমোড় খাড়া করব্যার পাবার লাগচ্যি ন্যা। আর আজনীতি!’ কুড়িগ্রামে এরশাদের অবস্থা কি? জানতে চাইতেই মোঃ ছলেমান নামের একজন খ্যেই খ্যেই করে করে উঠে বললেন, ‘থ্যোনতো এরশ্যাদের কত্যা। উঁয়ার কোনো আজনীতি আছে? বউ বোলে উঁয়াক......। এই চিলমার-রৌমারীর এমপি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যানী ভোট করিয়্যা ফেল কচ্ছিল্য। ত্যাই এ্যালা এমপি হইচে। য্যার ইউনিয়ন পরিষ্যদে খাওয়া ন্যাই, ত্যাই এমপি। বোঝ্যেন ঠ্যালা! ওগ্যুলা ভোট হইচ্যে বাহে? এরশাদের কত্যা যত কম কওয়া যায় তত ভাল।’ দেশের উন্নয়ন, ১০ টাকা চাউলের কেজি, জাতিসংঘের অধিবেশন থেকে ফিরে আসা প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা, বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা সবকিছুই আলোচ্য বিষয়। কথার মাঝে একজন লুঙ্গিপরিহিত বয়স্ক মানুষ বললেন, ‘মামলা দিয়্যা বিএনপির যে হাল করছ্যে তাতে বিএনপি কমোর সোজা করিব্যার প্যাবার নয় আগামী দশ বচোর’। প্রতিবাদ করে অরেকজন বলেন, বেগম জিয়া জামায়াতের ফাঁদে পড়ায় এ অবস্থা হয়েছে। দিল্লী কোনো ভাবেই বিএনপিকে সমর্থন করবে না। ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রখর রোদ, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। আড্ডা জমে উঠেছে। মানুষের পেশা বদল, চরের বাদাম, পাট ইত্যাদিও বাদ যায় না। তবে রাজনীতি নিয়ে সবাই হতাশ। ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝ দরিয়ায় আড্ডা যেন শেষ হচ্ছে না। নৌকার মাঝি দিক পরিবর্তনের সময় একটি ভেসে যাওয়া কলাগাছ দেখিয়ে বললেন, ‘স্যার ওখ্যান দিয়্যা ভারতের হাতিট্যা ভাসি গেইছে’। মনে পড়লো কিছুদিন আগে বানের পানিতে ভারত থেকে ভেসে আসা যে হাতি নিয়ে এতো কা- ঘটলো তারই কথা বলছে সে। সিগারেট ধরানোর জন্য ম্যাচ নিতে আসা এক যুবক জানালেন, তিনি ব্যাংকে চাকরি করেন। কুড়িগ্রামে থাকেন। সেখানে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকারের দেয়া ১০ টাকা কেজি দরের চাল ক্রয় করতে হলে একশ’ টাকা করে ঘুষ দিয়ে নাম লেখাতে হয়। গল্পে-আলাপে দুই ঘন্টার নদীপথের প্রায় দেড় ঘন্টা চলে গেছে। এতোক্ষণ নীরবে আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক শুনছিলেন সোহরাব হাসান। ৭৫ বছর বয়সী হাইস্কুলের এই সাবেক শিক্ষক মুখ খুললেন। বললেন, শোনেন। রাজনীতির যদি নিশানা ঠিক থাকে তাহলে মামলা কোনো ব্যাপার নয়। মুক্তিযুদ্ধের আগে ষাটের দশকে রাজনীতির ইতিহাস জানেন না? আমরা দেখেছি। মামলা-মোকদ্দমা, জেল-জরিমানা, গুম-হত্যা-ক্রসফায়ার ইত্যাদির খড়গ ঝুলিয়ে রাজনৈতিক মেঠো কর্মকা- সাময়িকভাবে স্তব্ধ করা যায়, দীর্ঘদিন সম্ভব নয়। নবাব সিরাজ উদ দৌল্লার পতনের পর ব্রিটিশ দখলদারিত্বের আমলে তাদের হুকুম ছাড়া সূর্যও নাকি অস্ত যেত না। উপমহাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণ ঠিকই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের তাড়িয়েছে। ’৪৭-এ দেশভাগের পর পাকিস্তান আমলে আমাদের ভূখ-ের কথাই ধরুন। ক্ষমতাসীনরা কখনো ভাবে না রাষ্ট্রীয় নানা বাহিনী ও অস্ত্র গোলাবারুদ কখনোই জনগণের সম্মিলিত শক্তির চেয়ে অধিক শক্তিশালী নয়। জনগণ কখনোই পরাজিত হয় না। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইউব-ইয়াহিয়া জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা-সন্ত্রাসের মাধ্যমে বাঙালি জাতির মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন এবং স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিকে গুঁড়িয়ে দিতে কি না করেছে। পেরেছে? পাকিস্তান আমলে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ (তখনো বঙ্গবন্ধু হননি) শত শত নেতাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ঘোষণার পর মিসেস আমেনা বেগম ছাড়া আওয়ামী লীগ অফিসে ‘বাতি জ্বালানোর’ লোক ছিল না। আইউবপন্থি দলের নেতারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলাবলি করতেন ‘দেশ এগিয়ে চলছে বিরোধীদের ঠা-া করে দেওয়া গেছে’। ভিতরে ভিতরে মানুষের হৃদয়ে যে তুষের আগুন জ্বলছিল ধিকি ধিকি করে, গণবিচ্ছিন্ন শাসকচক্র তা আমলে নেয়নি। তখনো এই বাংলাদেশে কিছু কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক আইউব খাঁর বন্দনা করে কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। লম্বা লম্বা নিবন্ধ লিখেছেন কত চাটুকার! স্তাবক-চাটুকারদের সবার মুখে একই আওয়াজ ‘সব ঠিক হ্যায় কুচ পরোয়া নেহি।’ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু কারাগারে। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী সিংহের মতো গর্জে ঘোষণা দিলেন, ‘মুজিবকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজনে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করবো।’ জেগে উঠলো ছাত্র-শিক্ষক-জনতা। শ্লোগান উঠলো লাখো কণ্ঠে ‘জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। পরবর্তী ইতিহাস সবার জানা। কাজেই মামলা চিন্তায় বিএনপির যারা ‘মরার আগে মরছেন’ তাদের উচিত রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া। বৃদ্ধের বক্তব্য অনুগত ভক্তের মতো সবাই শুনলেন। বেয়াড়া টাইপের এক ছেলে বললেন, ‘চাচা আপনিতো কইল্যেন দেশপ্রেমের কতা। এখন নেতাদের মধ্যে কি দেশপ্রেম আছে? এখন সুবিদাবদীতে সব দল ভরি্য গেইচ্যে।’
নৌকা রৌমারী ঘাটে ভিড়ছে। নামার প্রস্তুতি নিতে হলো। ব্রহ্মপুত্রের ঘাট থেকে রৌমারী সদর তিন কিলোমিটার পথই খানাখন্দ ও কাদায় মাখামাখি। ব্যাটারীর ভ্যানে উঠে রওয়ানা দিলেও এটুকু পথে ৫ বার নামতে হলো। কথা ছিল রৌমারী সদরে নিতে লোক আসবে; থাকার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু চার ঘন্টা অপেক্ষার পরও আসেনি। মাঝে মাঝে ফোন করে জানাচ্ছে আসছি। কিন্তু দেখা নেই। বুঝতে বাকি রইলো না প্রতারণার শিকার হয়েছি। সারাদিন ঘুড়ঘুড়ি করায় শরীর ক্লান্ত। হোটেলে ওঠা দরকার। কিন্তু চরের মধ্যে উপজেলায় সদরে আবাসিক হোটেলের সন্ধান দিতে পারলেন না কেউ। চরের শহরে রাত ৯টা মানে রাজধানী ঢাকার মধ্যরাত। মানুষজনের চলাফেরা কমে গেছে। শহর ফাঁকা। টেলিটকের নেটওয়ার্ক নেই। বিদ্যুৎও নেই; কখন আসবে কেউ জানে না। সব রাস্তাই কাদা। কাদায় হাঁটা-চলা করায় গোটা শরীর কাদায় ভরে গেছে। ঢাকার সবগুলো বাস রাত ৭টা থেকে ৯ টার মধ্যে ছেড়ে গেছে। রৌমারীর বড়াইবাড়ি সীমান্ত দেখতে এসে চরম বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়তে হলো। কি করবো, কোথায় যাব? দুরবস্থা বুঝে এক কিশোর সহায়তা করতে এগিয়ে এলো। সে নিয়ে গেল দেড় মাইল দূরে এক বাস কাউন্টারে। রাত ১০ টায় একটি বাস ঢাকা যাবে ছাগল-ভেড়া আর ঢাকায় নির্মাণ শ্রমিক নিয়ে। সে বাসেও সিট নেই। ২০ টাকা ঘুষ নিয়ে দয়া করে পিছনের একটি সিটের ব্যবস্থা করলেন। সামনে কয়েকটি সিটে ছাগল-ভেড়া বেঁধে রাখা হয়েছে। ওপরে হাঁস-মুরগির খাঁচা। বাসের দুই পার্শ্বের সিটের মাঝখানেও ভেড়া দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। ভেড়া-ছাগল ডিঙ্গিয়ে পিছনের সিটে বসতে হলো। চতুর্দিকে অন্ধকার। ভাঙ্গাচোরা রাস্তা। ছাগল-ভেড়ার ম্যা-ম্যা, ভ্যাঁ ভ্যাঁ ডাকাডাকির যন্ত্রণা। এক সময় বাস ছেড়ে দিল ঢাকার পানে। বাতাসে উড়ে আসা মুরগির বিষ্ঠায় ভরে গেল শরীর। ছাগল-ভেড়ার প্র¯্রাবের বিকট গন্ধে বমি আসার উপক্রম। তারপরও ভাগ্য ভাল পিছনের সিট পেয়েছি। বাস চলছে। পিছনে পড়ে রইলো রৌমারী। বড়াইবাড়ি সীমান্ত দেখার স্বপ্ন থেকে গেল স্বপ্নের মধ্যেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন