বর্ষা শেষে শরৎকালে দেশের প্রায় সব নদ-নদীতেই টলমল করছে স্বচ্ছ পানি। পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তাসহ প্রধান প্রধান নদীগুলো বর্ষায় বিপদসীমা অতিক্রম করলেও এখন এসব নদীর পানি প্রবাহ স্বাভাবিক। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদীও পানিতে টইটম্বুর। তবে দেশের অন্যান্য বড় নদীর মতো এর পানি টলটলে স্বচ্ছ নয়। ময়লা আবর্জনায় ভরা ঘোলা এ পানিতে কোন প্রাণ নেই, নেই কোন উচ্ছ্বলতা। প্রবল স্রোতের টান বা ঢেউয়ের কলকল ধ্বনি কিছুই নেই। কালচে রঙের দুর্গন্ধময় পানি না থাকলেও ঘোলা ময়লা পানিতে বুড়িগঙ্গা যেন নিথর এক মরা নদী।
দখল আর অতিরিক্ত দূষণেই বুড়িগঙ্গা আজ প্রাণহীন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শিল্পবর্জ্য, পয়ঃবর্জ্য, সিটি কর্পোরেশনের কঠিন বর্জ্য, নৌযানের বর্জ্য অবাধে বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশছে। বাবুবাজার ব্রিজ থেকে পোস্তগোলা ব্রিজ পর্যন্ত নদীর দুই পাড়েই ফেলা হচ্ছে গৃহস্থালি বর্জ্য, গার্মেন্টসের জুটসহ বিভিন্ন ধরনের কঠিন বর্জ্য। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন সুয়ারেজের ড্রেন দিয়েও ময়লা যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। ওয়াইজ, ঘাট, সদর ঘাট, শ্যামবাজার এই এলাকাতেই কয়েকটি সুয়ারেজ ড্রেন বুড়িগঙ্গায় মিশতে দেখা যায়। সদর ঘাটের ওপাড়ে অর্থাৎ কেরানীগঞ্জের দিকে নদী রক্ষার যে সীমানা পিলার দেওয়া হয়েছে সেটা নদীর অনেক জায়গা ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে পরিবেশবাদীদের অভিযোগ।
কেরানীগঞ্জের পূর্ব আগানগরের চরকালিগঞ্জে গিয়ে দেখা যায়, যেখানে নদীর সীমানা পিলার দেওয়া হয়েছে তার অনেক উপরে দখল করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে অর্ধশতাধিক ডকইয়ার্ডের অফিস ভবন, বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বাবু বাজার ব্রিজ থেকে পোস্তগোলা ব্রিজ পর্যন্ত এলাকায় যে অর্ধশত ডকইয়ার্ড রয়েছে তাতে দিনে রাতে নৌযান মেরামতের কাজ চলছে। এতে পুরানো নৌযানের আবর্জনা ও বিভিন্ন ক্যামিকেল বর্জ্য প্রতিনিয়ত নদীর পানিতে যাচ্ছে। কেরানীগঞ্জের পূর্ব আগানগরের চরকালিগঞ্জে বুড়িগঙ্গার সাথে যে সংযোগ খাল তা দখল করে দুইদিকে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন মার্কেট, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ইত্যাদি। এর মধ্যে খালের উপরে রয়েছে এস আলম সুপার মার্কেট ও শেখ সাদী গার্মেন্টসের বিশাল ভবন। দখলের পর এই সরু খাল দিয়ে এখন কলকারখানার নানা বর্জ্য এবং গৃহস্থালি বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় মিশছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সোবহান ইনকিলাবকে বলেন, নদী রক্ষার নামে যে সীমানা পিলার দেওয়া হয়েছে তাতে নদীর দখলকৃত অনেক জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এতে অবৈধ দখলদারদেরকে নদীর জায়গা এক রকম ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এটা অনেকটাই নদী রক্ষার নামে নদীকে আরও মেরে ফেলার মতো অবস্থা। এছাড়া বুড়িগঙ্গা নদীর দুইপাড় ঘিরে অপরিকল্পিতভাবে অসংখ্য ছোট ছোট কলকারখানা, গার্মেন্টস গড়ে উঠেছে। এগুলোর বর্জ্য, ক্যামিক্যাল ও রং নদীর পানিতে প্রতিনিয়ত মিশে দূষিত করছে। এটা দেখার কেউ নেই। রাজধানীর ওয়াসার যেসব পয়নিস্কাশন লাইনের সংযোগ নদীর সাথে রয়েছে সেগুলো বন্ধের জন্য উচ্চ আদালত নির্দেশ দিলেও তা আজও কার্যকর হচ্ছে না। নদী রক্ষায় নানা প্রকল্প নেয়া হয়। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। সব মিলিয়ে আমাদের কাছে এটাই প্রতিয়মান হয় যে নদী রক্ষার বিষয়টিকে সরকার খুব এটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে না। তা না হলে চোখের সামনে নদীকে এভাবে দখল আর দূষণে মরে যেতে দিত না।
পরিবেশবাদীদের মতে, বুড়িগঙ্গার দূষণের ক্ষেত্রে মোট চারটি বড় উৎসকে দায়ী করেছেন। সেগুলো হলো শিল্পবর্জ্য, পয়ঃবর্জ্য, দুই সিটির কঠিন বর্জ্য এবং নৌযানের বর্জ্য। তারা বলেন, সরকারের একাধিক প্রতিষ্ঠানের দায় আছে এসব দূষণে। রাষ্ট্রের টাকা ব্যয় করে তারা দূষণ কাজ পরিচালনা করে। কিন্তু এসব দফতর একে অন্যর ঘাড়ে দায় চাপিয়ে পার পেতে চায়। এভাবে চলতে থাকলে নদী রক্ষা করা সম্ভব না। শিল্পবর্জ্য, পয়ঃবর্জ্য, দুই সিটির কঠিন বর্জ্য, নৌযানের বর্জ্য আর দখল নিয়ন্ত্রণ করা গেলেই নদী ফিরে পাবে তার স্বাভাবিক রূপ।
বুড়িগঙ্গায় সরেজমিন দেখা গেছে, ওয়াসার অনেকগুলো সুয়ারেজ লাইন রয়েছে। এসব সুয়ারেজ লাইনে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট না থাকায় সরাসরি নদীতে ওয়াসার বিষাক্ত পানি ফেলা হচ্ছে। শ্যামবাজার ঘাটের পাশেই এরকম একটি সুয়ারেজ লাইন দিয়ে ময়লা নদীতে মিশতে দেখা যায়। সুমন নামের এক মাঝিকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, এরকম ময়লার ড্রেন আরও অনেক আছে। এগুলো দিয়ে শহরের ময়লা সব নদীর পানিতে মিশছে। এখনতো নদীতে ভরা পানি। তারপরও ময়লা ও ঘোলা পানি। কিছুদিন পরতো এ পানি একেবারে কালচে এবং দুর্গন্ধময় হয়ে যাবে। শুধু তাই নয় নদীতে শিল্পকারখানার বর্জ্য, গৃহস্থালি ও মেডিকেল বর্জ্য এমনকি প্লাস্টিকের বর্জ্যও দেখা গেছে।
বুড়িগঙ্গার চরকালিগঞ্জের হাইক্কার খালের মুখে কথা হয় আরমান নামের এক মাঝির সঙ্গে। তিনি জানান, প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে বুড়িগঙ্গায় খেয়া নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। একসময় এ নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। ঢাকার মানুষের মাছের চাহিদার বড় একটি অংশ সরবরাহ হতো বুড়িগঙ্গা থেকে। তবে গত একযুগ ধরে শুধু বর্ষায় কিছু মাছ পাওয়া যায়। বাকি সময় নদীতে মাছ থাকে না। তিনি বলেন, নদীতে এখন ভরা পানি। তাই পানি কিছুটা হলেও ভালো। কিছুদিন পর এই পানি কালো দুর্গন্ধময় হয়ে যাবে। তখনতো পানিতে মাছ থাকা দূরের কথা পোকামাকড়ও বাঁচতে পারে না।
পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, বুড়িগঙ্গায় পরিবেশ দূষণ বন্ধে আমরা বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছি। সম্প্রতি শ্যামপুর, কদমতলী এলাকায় বেশকিছু কারখানায় ইফলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) না থাকায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের এ ধরনের পদক্ষেপ অব্যাহত থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন